নিরীহ মুখে নির্দোষ এক প্রশ্ন। কিন্তু এতেই বোধহয় প্রশ্নকর্তাকে বেকুব ঠাওরালেন ট্যাক্সি ড্রাইভার। ‘সবাই চেনে। মুরালি আর সাঙ্গাকারার বাসা আমরা সবাই চিনি’Ñ কেতাবী ভদ্রতা রেখে মুখে বললেন এটি। আর মনে মনে যে প্রশ্নের সারল্যে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে নিলেন, সেটি বুঝতে অসুবিধা হয়নি এতটুকুন!
ক্যান্ডির ধর্মরাজা কলেজ লেনের ২১ নম্বর বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল ট্যাক্সি। এরপর চোখের সামনে যা ভেসে উঠল, সেটিকে ছবির মতো সুন্দর বললে সবটা বলা হয় না। লাল টালির ছাদের সাদা দোতলা বাড়ি। যার তিন দিক খোলা। শতবর্ষী বেশ কিছু অচিন বৃক্ষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে। আবার ঠিক আমাদের দেশের মতো বরই আর আম গাছের দেখাও মিলল। একপাশে ছোট্ট বাগান। চারপাশে অবারিত সবুজ। পাহাড়ের চূড়ার এই বাড়িটিই আইসিসির বর্ষসেরা ক্রিকেটার কুমার সাঙ্গাকারার আঁতুড়ঘর। তাঁর শৈশব-কৈশোর আর তারুণ্যের প্রথম ভাগের সাক্ষী!
মুরালির মতো সাঙ্গাকারার ক্রিকেটীয় ব্যস্ততা কমেনি। বরং আছেন ক্যারিয়ারের মধ্যগগণে। এই এখনো তো শ্রীলঙ্কাকে টোয়েন্টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতানোর অভিযানে আছেন কলম্বোয়। সাঙ্গাকারা নন, আমাদের আগ্রহের চৌম্বকক্ষেত্র তাঁর মা। বিশ্বজয়ী সন্তানকে নিয়ে রতœগর্ভা জননীর গর্ব আর অহংকারের চাক্ষুষ হতে চাই। রঙিন শৈশবের দুরন্ত দিনগুলোয় কিভাবে একটু একটু করে সাঙ্গাকারার গতিপথ আঁকা হয়ে গেল ক্রিকেটেÑ জানতে চাই তা।
এলেন তিনি। পরিপাটি হয়ে এক ঝলক আভিজাত্য নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ছিলেন একসময়, স্বামী এটর্নি অ্যাট ল। চার সন্তানের প্রত্যেকেই আজ স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। পরিচয় দিয়ে নিজেদের উদ্দেশ্যের কথা বলতে কুমার সাঙ্গাকারার মা কুমারি সাঙ্গাকারার চোখে-মুখে যেন ছলকে উঠল দ্বিধা। ছবি তোলার সময় তো আরো বেশি। শুরুতে বুঝিনি কারণটা। পরে বুঝলাম, প্রচার-প্রচারণায় উৎসাহ নেই এতটুকুন। তবু ভিনদেশের সাংবাদিক বলেই হয়তো ফেরালেন না।
‘এই যে বাড়িটা দেখছেন, কুমারের এক বছর বয়সে আমরা এখানে চলে আসি। চার পাশে ওরা চার ভাইবোন কতো ছুটে বেড়িয়েছে! আর কুমারের বই পড়ার নেশা সেই ছোটবেলার থেকে। খেলাধূলার নেশাটা অবশ্য আরো বেশি’Ñ স্মৃতির ঝাঁপি খুলে পরম মমতায় বলে যান কুমারি। ছেলে-মেয়েরা খেলাধূলায় অতি উৎসাহী হলে তো ‘উচ্ছন্নে যাচ্ছে’ বলে বাবা-মা হামলে পড়েন। এক্ষেত্রে এই পরিবারটি ব্যতিক্রম। কৃতিত্বটা অবশ্য নিজের স্বামীকেই দেন কুমারি, ‘আমি কখনো কখনো একটু আশঙ্কায় থাকতাম। কিন্তু আমার স্বামী সবসময় ওদের খেলায় উৎসাহ দিতেন। বলতেন, যদি ওরা ঠিকঠাক অনুশীলন করে খেলায় একটা ভালো জায়গায় যেতে পারে, তাহলে তো একই পদ্ধতি অনুসরণ করে পড়াশোনাতেও ভালো করবে। এত বছর পর বুঝি, তাঁর দর্শনটাই ঠিক।’
সাঙ্গাকারাদের চার ভাই-বোন তাই মাঠ-ঘাট দাপিয়েছেন বাঁধনহারা স্বাধীনতায়। পেয়েছেন সাফল্যও। বোন সারাঙ্গা ১৫ বর বয়সে হয়েছেন শ্রীলঙ্কার টেনিস চ্যাম্পিয়ন, ভাই অফ স্পিনার হিসেবে খেলেছেন ট্রিনিটি কলেজে, আরেক বোন তুষারিও মাতিয়েছেন স্কুল-কলেজের খেলার আঙ্গিনা। আর এদের সবাইকে ছাপিয়ে কুমার সাঙ্গাকারা। আইসিসির বর্ষসেরা পুরষ্কার নিয়ে ক’দিন আগে মঞ্চে দাঁড়িয়ে যিনি বলেছিলেন, ‘বাবা আমাকে এখনো বলে, এমন গাধার মতো ব্যাটিং করে তুমি জাতীয় দলে খেল কি করে?’ পিতা-পুত্রের সম্পর্কটা কি এমনই বন্ধুতার? হেসে সায় দেন কুমারি, ‘ওর বাবাকে তো আমি চিনি। কখনোই খুশির প্রকাশ দেখাবে না। সবসময়ই সমালোচনা করবে যেন কুমার আরো ভালো করতে পারে। এখনো পৃথিবীর যে কোন জায়গায় যে কোন ম্যাচে ওকে ভুল শট খেলতে দেখলেই ফোন করে বকাবকি করে।’ কুমারি স্কুলে খেলতেন নেটবল। তাঁর স্বামী কেশিমা সাঙ্গাকারার সময় কেটেছে ক্রিকেট, হকি, অ্যাথলেটিক্সে। কোনটিতেই অবশ্য শীর্ষ ছুঁতে পারেননি। নিজের অপূর্ণতা ঘোচানোর জন্যই কি সন্তানদের খেলাধূলায় এত উৎসাহ দিতেন? মেনে নেন কুমার সাঙ্গাকারার মা, ‘হতে পারে। নিজে বড় কোন খেলোয়াড় হতে পারেনি বলেই হয়তো এমন করত ও। তাতে তো ওদের কারো ক্যারিয়ারের কোন ক্ষতি হয়নি। আমার বাকী যে তিন ছেলেমেয়ে পরে আর খেলেনি, তাদেরও না।’
অভিভাবক হিসেবে কুমারি-কেশিমা দম্পত্তির গর্বের তাই সীমা নেই। ক্রিকেট খেলতে খেলতে তাঁদের ছেলে একদিন শ্রীলঙ্কা জাতীয় দলের অধিনায়ক হয়েছে, পেয়েছে আইসিসির শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতিÑ আর কী চাই! আছে, মা কুমারির আরেকটি চাওয়া আছে, ‘আমার আর ওর বাবার এখন একটাই আশাÑ পড়াশোনাটা যেন ও শেষ করে। ইউনিভাসির্টি অব কলম্বোর ল ফ্যাকাল্টিতে পড়ছিল। ক্রিকেটের চাপে ডিগ্রিটা নেওয়া হয়নি। আমি আশা করব, ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষে কুমার ওই পড়াশোনাটা শেষ করবে। তা এরপর পেশা হিসেবে এটিকে বেছে নিক বা না নিক।’
২০০৩ সালে বাল্যবান্ধবী ইয়েহালিকে বিয়ের পর ক্যান্ডির এই বাসা ছেড়েছেন কুমার সাঙ্গাকারা। এখন থাকেন কলম্বোর হোকান্দারায়। যমজ সন্তান আছে তাদের। ক্রিকেটসূচীর ফাঁক গলিয়ে ছুটিছাটা মিলতেই সব্বাই মিলে চলে আসেন ক্যান্ডির ধর্মরাজা কলেজ লেনের এই ২১ নম্বর বাড়িতে। পুরনো দিনগুলোর কথা যেন তখন বেশি করে মনে পড়ে কুমারির, ‘চার ভাইবোন মিলে কতো দুষ্টামিই যে করত! কুমারকে এখন ক্রিকেট মাঠে এমন ধীরস্থির দেখে ভুল বোঝার কারণ নেই। এই চারপাশের প্রতিবেশীদের জিজ্ঞেস করে দেখুন। দূর থেকে ওদের বাড়িতে পটকা ছুঁড়ে মেরে তাদের ও জ্বালাত ভীষণ।’
বলতে বলতে আবেগে বুঁজে আসে কুমারি সাঙ্গাকারার গলা। আবার সেই দস্যি ছেলে এখন বিশ্বজয়ী বলে গর্বের রেশও তো তাতে স্পষ্ট!
Discussion about this post