সিরিজ শুরুর আগে কিছু কথা-
লক্ষ্য ড্র। চাই কঠিন লড়াই। ভালো ব্যাটিং।
সিরিজ শেষে যা মিলল-
ড্র’র জায়গায় হোয়াইটওয়াশ। লড়াই তো হলই না, যা হল তার নাম আত্মসমর্পণ। আর ব্যাটিংয়ের নামে যা হল তা নিয়ে ক্রিকেট বিশ্বে হাসি-তামাশা চলল গোটা সিরিজ জুড়েই!
ওয়ানডেতে ৩-০। টেস্ট সিরিজে ২-০। মাঝে বৃষ্টি বাঁচিয়ে দিল বলে টি-টুয়েন্টি শেষ হল কোনো ফল ছাড়াই। ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং-ম্যাচ পরিকল্পনা এক অর্থে এবারের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ক্রিকেটীয় সবকিছুতেই বাংলাদেশ দল ভয়াবহভাবে ব্যর্থ হয়েছে। টেস্ট সিরিজে এক বা দুটো সেশনে কিঞ্চিত্ আশার আলো জ্বললেও খানিকবাদেই এক ফুঁত্কারে সেটা নিভেও গেছে।
পুরো সিরিজে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স দেখে মনে হয়েছে-বড় বেশি অপ্রস্তুত অবস্থায় মাঠে নেমেছিল মুশফিক রহিমের দল। ম্যাচের প্রায় সবকিছুতেই আস্থার ঘাটতিটা প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। ভুলে ভরা এ ক্রিকেট সিরিজ লগবুক থেকে বাংলাদেশ দল ঘষে মুছে ফেলতে চাইবে।
কিন্তু ক্রিকেট যে বড় নিষ্ঠুর!
ওয়ানডে সিরিজে শুরুর চার ব্যাটসম্যান ওপেনার! টেস্টে এ সংখ্যাটা একটু কমল, তিনজন। কিন্তু দলের ব্যাটিং দুরবস্থা আর কাটল না। কোনো ইনিংসেই বাংলাদেশের ওপেনিং জুটি দাঁড়াতেই পারল না। প্রথম টেস্টের একাদশে আটজন ব্যাটসম্যান নিয়ে খেলতে নামল বাংলাদেশ। ম্যাচের দুই ইনিংসেই দল ব্যর্থ। প্রথম দফায় ১৮২ রানে অল আউট। দ্বিতীয় দফায় হার যখন প্রায় নিশ্চিত তখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কোনোক্রমে তিনশ’ পার করা। আট ব্যাটসম্যান নিয়ে একাদশ সাজানোর ফর্মুলা ফেল মারল।
সিরিজের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ব্যাটিংয়ের একই চিত্র দেখতে হয় বাংলাদেশকে। কিংসটাউনে সিরিজের প্রথম ম্যাচের উইকেট ছিল পুরোপুরি ব্যাটিং সহায়ক। কিন্তু সেই সুবিধাটা নিতে পারল কই বাংলাদেশ? উইকেটে গিয়েই দ্রুত রান তোলার তাড়ায় পেয়ে বসে পুরো দলকে। টেস্ট ক্রিকেটে যে উইকেটে সময় কাটানো একটা বড় ফ্যাক্টর-সেটা টেস্ট ক্রিকেটের প্রাথমিক জ্ঞান। এখন অভিষেকের ১৪ বছর পর এসে কেন সেই প্রাথমিক জ্ঞানের কথাও বাংলাদেশকে মনে করিয়ে দিতে হবে। টেস্টে উইকেট পেতে একজন বোলারকে অনেক কষ্ট করতে হয়। কিন্তু প্রতিপক্ষ যখন বাংলাদেশ তখন বোলারদের কষ্ট যে অনেক কমে যায়। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা উইকেট উপহার দিয়ে আসছেন যে!
প্রমাণ চান? ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের দুই টেস্টের চার ইনিংসে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের আউটের রিপ্লে দেখে নিন।
টেস্টে ব্যাট করতে নেমেই গা গরম হয়ে ওঠার আগেই ডাউন দ্য উইকেটে এসে বোলারকে উড়িয়ে ছক্কা মারার মতো বোকামো শুধু বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের পক্ষেই সম্ভব।
এমনভাবে উইকেট বিলিয়ে দেওয়াকে কী বলবেন আপনি?
উত্তরে দাঁত কেলিয়ে সেই ব্যাটসম্যান বলবেন-‘আমি যে এভাবেই খেলে অভ্যস্ত!’
১৮২, ৩১৪, ১৬১ ও ১৯২-চার টেস্ট ইনিংসে বাংলাদেশের এ খুদ কুড়ানো ভঙ্গির সঞ্চয় জানাচ্ছে, এই দলের ব্যাটিং নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। টানা নয় ইনিংসে যে ব্যাটসম্যান সাকল্যে একটা হাফসেঞ্চুরিও করতে পারেন না-তাকে দলে খেলানো হচ্ছে ফিনিশার হিসেবে!
ফিনিশারের দায়িত্ব পালন করবেন কী-আরে তিনি তো নিজে হচ্ছেনই, দলকেও ‘ফিনিশ’ করে ফেলছেন ভাই!
দলে টেস্ট ব্যাটিংয়ের টেকনিকে যিনি সবচেয়ে ভালো, ফর্মেও আছেন-সেই মুশফিক কেন ব্যাটিং অর্ডারে এত দেরিতে নামবেন? ঘরের মাটিতে জিম্বাবুয়ে সিরিজের আগে দ্রুত এসব প্রশ্নের সমাধান খুঁজতে হবে দলকে।
পঞ্চাশ রান তোলার পর ঢেঁকুর তুলে ড্রেসিংরুমে ফিরে আসার কুঅভ্যাস থেকে কবে মুক্তি পাবেন আমাদের ব্যাটসম্যানরা। দলের কাজে না লাগলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে হাফসেঞ্চুরির কোনো মূল্য নেই। আর দলে কাজে লাগতে পারলে ৩০০ বল খেলে অপরাজিত ৩৩ রানই অনেক কার্যকর। প্রাতঃস্মরণীয়ও বটে!
২০ টেস্টে ২৬ উইকেট। এমন বোলারকে আমরা খেলাচ্ছি স্ট্রাইক বোলার মর্যাদা দিয়ে! যার বোলিং গড় নিয়ে প্রায়ই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মহলে হাসাহাসি ওঠে। টেস্ট ক্রিকেটের সঙ্গে মানানসই কি না-এটা প্রমাণ করার জন্য ২০ ম্যাচ যথেষ্ট। নাকি এ বেচারা বোলারকে দিয়ে আরও ২০ টেস্ট চেষ্টা চালাবেন নির্বাচকরা?
এই টেস্ট সিরিজে মাত্র একবার ওয়েস্ট ইন্ডিজকে অল আউট করতে পেরেছে বাংলাদেশ। তাও ক্যারিবীয়রা ততক্ষণে ৩৮০ রান তুলে ফেলেছে। আর বাংলাদেশ তাদের ব্যাটিংয়ের চার ইনিংসেই অল আউট হয়েছে। চার ইনিংসে মাত্র একবারই একশ’র বেশি ওভার খেলেছে। বাকি তিনবারই ৭১.৪, ৬২.৩ ও ৭৭.৪ ওভার খেলে ব্যাটসম্যানরা ব্যাটিংয়ের নামে যা করে এলেন তাকে আর যাই হোক-টেস্ট ব্যাটিং বলা চলে না। এর নাম আত্মসমর্পণ।
ব্যাটিং-বোলিংয়ে না পারলে অন্তত ফিল্ডিং তো ভালো হবে। সেখানেও এ সিরিজে বাংলাদেশ ব্যর্থ। স্লিপে ক্যাচ ধরতে পারেন-এমন স্পেশালিস্ট ফিল্ডারই আজ পর্যন্ত পেল না বাংলাদেশ।
এক সাকিব আল হাসান না থাকায় পুরো দলের ব্যাটিং-বোলিংয়ের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ব্যর্থতার দায়ভার যে বিসিবিরও। ক্রিকেটাররা মাঠে আত্মসমর্পণ করেছেন। আর বিসিবি মরেছে প্রশাসনিক ‘আত্মহত্যায়’!
ফুটনোট : প্রথম পাঁচ ওয়ানডেতে হার। প্রথম দুই টেস্টে বড় হার। টেস্ট দলের কোচ হিসেবে চন্দিকা হাতুরাসিংহের অভিষেকটাও ভালো হল না।
এম. এম. কায়সার
লেখক দৈনিক সকালের খবরের ক্রীড়া সম্পাদক
Discussion about this post