বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে পরিশ্রমী ও অধ্যবসায়ী ক্রিকেটারদের কথা উঠলে মুশফিকুর রহিমের নামই সবার আগে আসে। দীর্ঘ দুই যুগ ধরে প্রায় অবিচ্ছিন্নভাবে তিন ফরম্যাটেই নিজের নিবেদন ও শৃঙ্খলা দিয়ে তিনি যেভাবে পথচলা সাজিয়েছেন, তার সেরা অধ্যায়টি যেন লেখা হলো গত বুধবার।
শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে মাঠে নেমে তিনি ছুঁলেন এক ঐতিহাসিক মাইলফলক-বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে শততম টেস্টে অংশগ্রহণ। কিন্তু মাইলফলকের গণ্ডি পেরিয়েই থেমে থাকেননি তিনি; ব্যাট হাতে গড়েছেন ইতিহাসের নতুন দৃষ্টান্ত।
প্রথম ইনিংসে দারুণ শৈল্পিকতার সঙ্গে মুশফিক যেদিন সেঞ্চুরি স্পর্শ করলেন, মাঠের গ্যালারিতে দাঁড়ানো দর্শকদের উচ্ছ্বাসে যেন মিশে গেল দেশের দুই দশক ক্রিকেট-ভ্রমণের স্মৃতি। দ্বিতীয় ইনিংসেও থামতে দেননি নিজেকে; আবারও ঠাণ্ডা মাথায় পঞ্চাশ ছুঁয়ে পৌঁছে গেলেন এমন এক ক্লাবে, যেখানে এতদিন ছিলেন শুধু একজন-অস্ট্রেলিয়ার রিকি পন্টিং। টেস্ট ক্রিকেটের শততম ম্যাচে দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি ও অন্তত এক ফিফটি, এমন কৃতিত্বের মালিক এখন বিশ্বের মোট দু’জন, পন্টিং ও মুশফিক। এক পৃথক স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা তার জন্য নিশ্চয়ই এক অন্যরকম গর্বের অনুভূতি।
যদিও আরেকটি ঐতিহাসিক রেকর্ড স্পর্শ করা থেকে তিনি বঞ্চিত হন অল্পের জন্য। দ্বিতীয় ইনিংসেও সেঞ্চুরির পথে ভালোমতো এগোচ্ছিলেন মুশফিক। শট সিলেকশন, ফুটওয়ার্ক, ব্যাটে–বল লাগার পর পরিষ্কার শব্দ-সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল কিছু বলের অপেক্ষা, আরেকটি সেঞ্চুরি থাকবে তার নামে। কিন্তু মুমিনুল হক আউট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইনিংস ঘোষণা করে দেয় বাংলাদেশ। দলের সিদ্ধান্তের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিসংখ্যানের দূরত্ব এখানেই তৈরি হয়। বিশ্ব ক্রিকেটে শততম টেস্টে দু’দুটো সেঞ্চুরির মালিক হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া হয়, তবে তার অপরাজিত ৫৩ রানের ইনিংসই যথেষ্ট তাকে আবারও ইতিহাসে জায়গা করে দিতে।
দিন শেষে ব্যাটিং কোচ মোহাম্মদ আশরাফুল পরিষ্কার জানান, এটি ছিল নিখাদ দলীয় সিদ্ধান্ত। দলের পুঁজি তখন ৫০০ রানের ওপরে, আর ম্যাচের নিয়ন্ত্রণও হাতের মুঠোয়। সেক্ষেত্রে কেবল ব্যক্তিগত অর্জনকে সামনে রেখে আরও এক ঘণ্টা ব্যাটিং করার প্রয়োজন অনুভব করেনি ম্যানেজমেন্ট। আশরাফুল স্বীকার করেন, মুমিনুলের সেঞ্চুরির সম্ভাবনা বিবেচনায় তারা সময় কিছুটা বাড়িয়েছিলেন। কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ হয়ে গেলে কৌশলগত চিন্তা থেকে দ্রুতই ইনিংস ঘোষণা করা হয়।
দুই ইনিংস মিলে মুশফিকের সংগ্রহ ১৫৯। বিশ্ব ক্রিকেটের শততম টেস্টে সবচেয়ে বেশি রান করা ব্যাটারদের তালিকায় তিনি এখন পাঁচ নম্বরে। তার ওপরে রয়েছেন পন্টিং, জো রুট, ইনজামাম উল হক ও ডেভিড ওয়ার্নারের মতো কিংবদন্তি নাম। শুধু রানই নয়, উইকেটরক্ষক হিসেবেও তিনি যুক্ত হলেন এক অনন্য তালিকায়—ইতিহাসে মাত্র আটজন কিপার টেস্ট খেলেছেন একশটি বা তার বেশি। সেই লাইনআপে এখন বাংলাদেশের প্রতিনিধিও আছে।
মিরপুরের ম্যাচে দলের সামগ্রিক অগ্রগতিও তার ব্যাট-বিস্ময়ের সঙ্গে দারুণভাবেই মিল খেয়েছে। বাংলাদেশ ৫০৯ রানের লক্ষ্য দিয়ে ইনিংস ঘোষণা করার পর দিন শেষ করেছে আয়ারল্যান্ড ৬ উইকেটে ১৭৬ রানে, যা ম্যাচের নিয়ন্ত্রণকে আরও স্পষ্ট করেছে বাংলাদেশের দিকে। মাঠের স্কোরবোর্ডের মতোই মুশফিকুর রহিমের ক্যারিয়ারের স্কোরবোর্ডেও যোগ হলো নতুন উজ্জ্বল অধ্যায়।










Discussion about this post