চাপে রয়েছেন তিনি। নতুন দফায় বাংলাদেশের দ্বায়িত্ব নিয়ে সময়টা ভাল কাটছে না চন্ডিকা হাথুরুসিংহের। এবারের বিশ্বকাপটা তো দুস্বপ্নের মতো কাটছে। দল হেরেছে টানা ৬ ম্যাচে। তার পরীক্ষা-নীরিক্ষা নিয়েও সমালোচনার ঝড় বইছে। ঠিক এ অবস্থায় রোববার গণমাধ্যমের সামনে আসলেন বাংলাদেশ হেড কোচ।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি যা বললেন তা তুলে ধরা হলো এখানে-
২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কার কোচ ছিলেন নিক পোথাস, দল তখন দিল্লি সফরে এসেছিল টেস্ট খেলতে, যখন এমনই খারাপ ছিল পরিস্থিতিটা। সে অভিজ্ঞতা কি তিনি আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করেছেন?
সে আমাদের জানিয়েছে পরিস্থিতিটা কেমন ছিল। আমরা একটা সেশন বাতিলও করেছি, আমরা একটু চিন্তিত ছিলাম। তো আমরা বাইরের আবহাওয়ার সঙ্গে আমাদের এক্সপোজারটা যথাসম্ভব কমানোর চেষ্টা করেছি। আমাদের প্রস্তুতি নেওয়া দরকার, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সতর্কতাও প্রয়োজন, কারণ এই পরিস্থিতি আমাদের শরীরে লম্বা সময়ের জন্য প্রভাব ফেলতে পারে।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আপনার তেমন ভালো রেকর্ড নেই দ্বিতীয় বার আসার পর। এ নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
বাতাসের মানটা প্রত্যেকটা দলেই প্রভাব ফেলছে। আর এটা মোটেও আদর্শ পরিস্থিতি নয় খেলার জন্য। তবে আমাদের সামনে আর বিকল্প নেই, যে কন্ডিশন আছে, সেখানেই আমাদের খেলতে হবে। তবে মাঠের কথা বললে বলতে হয়, মাঠটা খুব ভালো, সম্ভবত বিশ্বকাপে আমরা যে ধরনের পিচে খেলেছি, তার মধ্যে সবচেয়ে ভালো এটাই।
শ্রীলঙ্কা আর বাংলাদেশ শেষ কিছু দিনে বেশ কিছু ভালো ম্যাচ খেলেছে। তবে সত্যি বলতে দুই দলই এখন প্রায় কাছাকাছি পরিস্থিতিতে আছে, যত ওপরে সম্ভব শেষ করা যায়, সে ভাবনায় আছে, কারণ আমরা সেমিফাইনালে খেলার সুযোগটা হারিয়ে ফেলেছি। তবে এখনো চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলার বিষয়টা নিশ্চিত করা বাকি আছে। তো আমাদের যত ওপরে সম্ভব শেষ করতে হবে। এই ম্যাচটা বড় প্রভাব ফেলবে কে ওপরে থেকে শেষ করবে তার ওপর।
টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদ সুজন জানিয়েছেন, বাংলাদেশের ডিসিশন মেইকিং প্রোসেসে সমস্যা আছে। আপনার কী মত এই বিষয়ে?
আমি তার কথাটা দেখেছি। তবে সে এই বিষয়ে কারো সঙ্গে আলাপ করেনি। আমি এই বিষয়টা প্রথম দেখেছি মিডিয়ায়। এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না আমি, কারণ এই বিষয়ে আমি আগে কখনো কিছু শুনিনি।
জয় হার থাকবেই। তবে বাংলাদেশ এই বিশ্বকাপে যেভাবে খেলেছে, প্রথম ম্যাচের পর কোনো লড়াই করতে পারেনি, কোচ হিসেবে আপনি কতটা দায় নিচ্ছেন এই ব্যর্থতার? আর এই বিশ্বকাপের পর আপনি নিজেকে আর বাংলাদেশের কোচ হিসেবে দেখতে পাচ্ছেন কি না?
আমি দায় নিচ্ছি, দলের সবার মতোই। আমরা ভক্তদের হতাশ করেছি, আমরা নিজেদেরও হতাশ করেছি। আমরা আমাদের সেরা ক্রিকেটটা খেলিনি। তবে প্রথম ম্যাচ থেকে এখন পর্যন্ত কিছু বদলায়নি, যা বদলেছে তা হলো আমরা যা শুনছি। আমাদের স্কিল কিন্তু কোথাও চলে যায়নি। আমার মনে হয় অনেক বেশি আশা করে করে আমরা নিজেদের নিচে নামিয়ে দিয়েছি। এটাই আমরা ভাবতে পারি এখন কারণ আপনি ঠিকই বলেছেন, আমরা ভালো পারফর্ম করতে পারিনি, আমাদের যা সক্ষমতা আছে, বা বিশ্বকাপের আগে যেমন পারফর্ম করেছিলাম তেমন। সেই অর্থে আমাদের সবাইকে আয়নায় দেখতে হবে যে কোথায় আমাদের ভুল হয়েছে।
আর আমি কোচ হিসেবে থাকব কি না, সেটা বোর্ডের ওপর নির্ভর করছে।
এই কন্ডিশনে খেলে খেলোয়াড়দের যে লম্বা সময়ের জন্য প্রভাব পড়তে পারে, সেটা আপনি বলেছেন। আপনার দল নির্বাচনে কি তা প্রভাব ফেলবে? আরেকটা প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্বকাপটা ৪৫ দিন দীর্ঘ। ৪ দল খেলবে সেমিফাইনালে। আপনি এই ফরম্যাটটাকে কীভাবে দেখছেন? দুই সপ্তাহ আগেই আপনার চার সেমিফাইনালিস্ট নিশ্চিত প্রায়, অন্য দলগুলোর সুযোগটা কমে যায় তাতে…
আমার মনে হয় এটাই সেরা ফরম্যাট। কারণ আপনি যদি জিতে যান, তাহলে আপনার মনে হবে আসলেই আপনি সবার সঙ্গে খেলেছেন?
আর দল নির্বাচনটা বাতাসের মানের ওপর নির্ভর করছে না। এটা নির্ভর করে কন্ডিশন আর প্রতিপক্ষ আর আমাদের সক্ষমতার ওপর।
বাংলাদেশ স্কোয়াডে পাঁচ ফাস্ট বোলার আছে, তানজিম সাকিব এখনো খেলেনি। অন্যদিকে তানজিদ তামিম, নাজমুল হোসেন শান্ত, তাওহিদ হৃদয়, লিটন দাসরা খুব ভালো ছন্দে নেই। শান্ত তো ছয়টা সিঙ্গেল ডিজিটে আউট হয়েছে! আপনার কী মনে হয় তানজিমের জায়গায় আরও একটা ব্যাটার স্কোয়াডে বসিয়ে রাখলেই সবচেয়ে ভালো একাদশটা নির্বাচন করা যেত?
আমার মনে হয় না একজন বেশি ব্যাটার খেলালে আপনার পরিস্থিতিটা বেশি জটিল হয়ে যায়। বিশ্বকাপের আগেও এমন খেলিয়েছি আমরা, এরাই আমাদের সেরা ব্যাটার, তারা পারফর্মও করছিল। আমি আগেও বলেছি, আমাদের স্কিলটা চলে যায়নি। যা হচ্ছে সব আমাদের মগজে, এটাই আমাদের এখন সমস্যা করছে। আমরা আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী খেলতে পারিনি। নিজেদের সক্ষমতা নিয়েও সন্দেহে পড়ে গেছি। কিছু কারণে আমরা একটু নড়বড়ে হয়ে গেছি, বিশেষ করে ব্যাটিংয়ে, এখানে আমাদের কাজ করতে হবে। ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলতে হবে।
আপনি বললেন আমরা আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী ব্যাট করতে পারিনি। আপনার কি মনে হয় ব্যাটিং অর্ডারে যেভাবে পরিবর্তন এসেছে, তা একটা প্রভাব ফেলেছে?
বিষয়টা কিন্তু ব্যাটিং অর্ডারের নয়। বিষয়টা হচ্ছে ম্যাচের কোন পরিস্থিতিতে কোন সময়ে ব্যাট করতে আসছেন। এই বিষয়টা কত নম্বরে ব্যাট করতে আসছেন, এ থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ভালো কোনো সূচনা পাইনি, একটা ম্যাচ বাদে। আমাদের শীর্ষ চার ব্যাটার সেটা আমাদের দিতে পারেননি। আমার মনে হয় না ব্যাটিং অর্ডারের কোনো হাত আছে এই পরিস্থিতির পেছনে।
একিউআই ইনডেক্সে দিল্লির অবস্থা যেমন, তাতে কি আপনার মনে হয় নভেম্বরের শুরুতে এখানে খেলা আনা উচিত? দ্বিতীয়ত, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির জায়গাটা এখনো খোলা আছে বাংলাদেশের জন্য। আপনার কি মনে হয় এটা এখনো অর্জন করতে পারবে আপনার দল?
আমার মনে হয় এটা অর্জন করা সম্ভব, কারণ আমরা ভালো দল। আমাদের সেরা ম্যাচটা আমরা এখনো খেলিনি। এমনকি তার কাছাকাছিও কিছু খেলতে পারিনি। আমরা এখনো বিশ্বাস করি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি স্পটটা আমরা নিতে পারব। আর প্রথম প্রশ্নটার উত্তর দেওয়ার জন্য কোয়ালিফিকেশন আমার নেই। আমি জানি না বাতাসের মান কেমন, আর এই পরিস্থিতিতে এখানে খেলা উচিত কি না তাও জানি না।
বলছেন আপনি ব্যর্থতার দায় নিচ্ছেন, কিন্তু আপনার কি মনে হয় বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে আসতে যে প্রস্তুতিটা নেওয়ার দরকার ছিল, তা আপনি নিতে পেরেছেন?
আমি সাত মাস আগে শুরু করেছি, তো আমি সাত মাস সময় পেয়েছিলাম। তবে এর মধ্যে এমন কিছু ঘটেছে, যার নিয়ন্ত্রণ আমার কাছে ছিল না। আমার কাছে মনে হয় না এটা ঠিক সময় এটা আলোচনা করার… এই মুহূর্তে আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে এই ম্যাচ, কীভাবে ম্যাচটা জেতা যায়। আমরা সবকিছু ঠিকঠাক করছি। খেলোয়াড়রা অনুশীলন করছে, তাদের মুড ঠিক আছে। তারা সবাই খুব কঠোর পরিশ্রম করছে, সবাই ভালো করতে চাইছে। আমি দলের পরিস্থিতিটাকে কীভাবে চাপহীন রাখা যায়!
শেষ দুই ম্যাচ নেহাত মুখরক্ষার। পাকিস্তান ম্যাচের পর বেশ খানিকটা সময় পেয়েছেন। এ সময় কি আপনি কি কোনো কারণ খুজে বের করতে পেরেছেন দলের ব্যর্থতার পেছনে?
কোনো নির্দিষ্ট কারণ নেই। এখন যদি আমি কিছু বলি, তাহলে এটা আন্দাজে বলা হবে। আমার মনে হয় আমরা সবাই কঠোর চেষ্টা করছি। আমাদের একটা ভালো উদাহরণ দরকার। যেমন পাকিস্তান করেছে, শেষ ম্যাচে একজন দাঁড়িয়ে গেছে, আর ম্যাচটা বের করে নিয়ে গেছে। আমাদের দলেও এমন সক্ষমতা আছে খেলোয়াড়দের। একটা স্পেল বা একটা ইনিংসই দলে অনেক কিছু বদলে দিতে পারে।
নাজমুল হোসেন শান্ত, লিটন, সাকিবরা প্রায় একই ঢঙে প্রতি ইনিংসেই আউট হচ্ছে। তাদের ভুলটা কোথায় হচ্ছে?
ওরা একই ভাবে আউট হচ্ছে, এখানেই তাদের ভুলটা হচ্ছে। তাদের চেষ্টায় কোনো কমতি নেই। একই ভাবে আউট হচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে শান্ত, আপনি যদি খেলে থাকেন খেলাটা, তাহলে বুঝবেন যে কেউ প্রথম পাঁচ বলে আউট হতে পারে। সে আমার মনে হয় দুবার আউট হয়েছে প্রথম বলে। কিছু বলে সে আউট হয়েছে দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ডাউন দ্য লেগসাইড, হাফ ভলিতে… অন্য যে কোনো দিনে সেসব বলে তাকে বাউন্ডারি মারতে দেখবেন। কিছু কিছু জিনিস আমাদের জন্য ঠিকঠাক হয়নি… আমি আগেও বলেছি, এক বা দুইজনকে দাঁড়িয়ে যেতে হবে খেলাটাকে নিজেদের কাছে নিয়ে আসতে হবে আর পরের দুই ম্যাচে আমাদের ভাগ্যটা তাদেরই বদলে দিতে হবে।
শান্তর কথা বললেন, তিনি কয়েক বার ১০ বলের আগেই আউট হয়েছেন। তার কী হয়েছে? আপনি কি তার সঙ্গে কথা বলেছেন?
তার সঙ্গে নিয়মিতই কথা হচ্ছে, তবে আমরা কিছুই পাইনি। টেকনিকাল কিছুই নেই। আমি যেমন বললাম, বিষয়টা দূর্ভাগ্যজনক, কোনো ব্যাটার ১০ বা ৫ বলের ভেতর আউট হওয়া। এমনটা যে কোনো ব্যাটারের ক্ষেত্রে হতে পারে, বিশেষ করে টপ অর্ডার, কারণ তখন বল মুভ করছে, আপনি কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছেন। আমার মনে হয় না টেকনিকে কোনো সমস্যা আছে। এটা দুর্ভাগ্যজনক, এটাই ক্রিকেট, ক্রিকেটের সৌন্দর্য।
বিশ্বকাপের আগে আপনার দল বলেছিল সেমিফাইনালে খেলতে চায়। এই মুহূর্তে আপনার কি মনে হয় কথাটা ভুল ছিল?
না। কারণ আমরা সবাই ভালো করতে চাই। আমাদের সবার অনেক বড় আশা ছিল। আমাদের প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু এরপর আমরা তা অর্জন করে নিতে পারিনি। মন্তব্যটা ভুল ছিল না।
কোচ হিসেবে আপনি দায় নিচ্ছেন সেমিফাইনালে নিতে পারছেন না বলে। একজন কোচ হয়ে আপনি দলকে ভবিষ্যতের জন্য কী দিতে পারবেন?
সাত মাস হলো আমি এসেছি। সাত মাসে আমি খুব বেশি কিছু করতে পারব না। আমি যা করেছি, দল যেখানে ছিল, সে আবহটা বুঝে দল নিয়ে সামনে এগোনো, বিশ্বকাপের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া। আসলে আমার কাজটা বিশ্বকাপের পর শুরু হবে। বিশ্বকাপের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া আর ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নেওয়াটা দুটো ভিন্ন বিষয়, ভিন্ন চ্যালেঞ্জ।
Discussion about this post