- জাভেদ ওমর বেলিম
বাবা-মার দেওয়া নামটা বেশ বড়-জাভেদ ওমর বেলিম গোল্লা। সেই ছোট্টবেলায় বন্ধুদের কাছে অবশ্য জাভেদ আর গোল্লা নামেই পরিচিত ছিলাম। আমি পুরনো ঢাকার ছেলে। আপনারা জানে ওল্ড ঢাকার মানুষ মানে আমরা সব সময় আনন্দে থাকতেই ভালবাসি। পুরনো ঢাকা মানেই যেন হৈ হুল্লোড়, গল্প আর পেট পুরে জ্বিভে জল আনা খাবার আর উৎসব। রমজানের ইদ যখন সামনে তখন চলুন আমার সঙ্গে স্মৃতির বারান্দায় হেটে আসি। ফিরে যাই আমার হারিয়ে যাওয়া সেই শৈশবে।
আমার বাড়ি যে পুরনো ঢাকায় সেটা তো জেনেই গেছেন। আরেকটু সরাসরি বলা যায় বিখ্যাত হোসনি দালানের ছেলে আমি। তাইতো দুরন্তপনার সবকিছুই আছে আমার মধ্যে। অনেক কিছু দেখে বড় হয়েছি আমি।
আমাদের সেই শৈশবে তখন ঘরে ঘরে টেলিভিশন ছিল না। মোবাইল-কম্পিউটার আবিস্কারও সম্ভবত হয়নি। আমি বলছি সেই ১৯৮৪-৮৫ সালের কথা। আমরা তখন ভিসিআর ভাড়া করে নিয়ে আসতাম। সবাই চাঁদা দিত। নান্না মিয়ার বিরানি দিয়ে পেটপুজা করে রাত ভর চলতো সিনেমা দেখার আনন্দ! আবার অনেক মহল্লায় টিকিট কেটে ভিসিআরে সিনেমা দেখার সুযোগ ছিল। সে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। টিকিট কেটে বসে পড়তাম। আর ছোট্ট ঘরটায়-সবাই এমন করে সিগারেট খেতো যে শার্টের গায়েও গন্ধ লেগে থাকতো। তারপর বাসায় ফেরা মানে নির্ঘাত মার খাওয়া! তারওপর টিকিট কেটে কী সিনেমা দেখা হতো সেটা তো অবিভাবকরা জানতেন। এজন্য মারটা আরো বেশি পড়তো গায়ে।
আমি নবকুমার ইনস্টিটিউটের ছাত্র। অন্য অনেকের মতো স্কুল পালিয়ে অবশ্য সিনেমা না দেখে খেলতে বেড়িয়েছেন আমি বেশিরভাগ সময়। ক্রিকেটই ছিল আমার প্রান। অবশ্য ঘরে হকি খেলার চর্চাও ছিল। কিন্তু আমার দিনভর ব্যাট করতে ভাল লাগতো।
তবে বাংলা সিনেমা দেখার সুযোগটা কখনোই হাতছাড়া করতাম না আমি। সময় পেলেই ছুটে যেতাম হলে। অনেক সময় অবশ্য পরিবারের মানুষদের সঙ্গে যেতাম। তখন মা-খালা সবাইকে নিয়ে সিনেমা দেখার একটা রীতি ছিল। সিনেমাগুলোও ছিল সামাজিক। সবাইকে নিয়ে দেখার মতো।
আসলে আমার কাছে একটা সিনেমা মানে সুন্দর কিছু গান আর হাসি-কান্না। সেটা দেখে যদি মজা না পেলাম তাহলে দেখবো কেন? তবে বাংলা সিনেমার মজার মজার ডায়লগগুলো খুব ভালো লাগে আমার। যেমন ধরুন প্রেমিক তার প্রেমিকাকে বলছে-‘‘বৃষ্টি তুমি এতো সুন্দর কেন? এনে হয় তুমি আকাশ থেকে নেমে আসা ডানাকাটা পরী!’’-ব্যাপারটায় ছেলেমানুষি আছে, কিন্তু বেশ লাগে। এইসব নাটকীয়তা বেশ উপভোগ করি।
আবার যেমন ধরুন প্রেমিকা তার প্রেমিককে বলছে-, ‘শোন ইমন, তোমাকে অন্যরা দেখলে আমার গা জ্বলে। ইর্ষায় আমি মরে যাই। তুমি শুধু আমার! আজ থেকে অন্য কেউ তোমাকে দেখলে চোখ উপড়ে ফেলবো।’ এমন ডায়লগ শুনে হেসে লুটিয়ে পড়ি। বেশ মজা লাগে। ছোটবেলায় এই ডায়লগগুলো মুখস্ত করে ফেলতাম।
আসলে শুধু নায়ক-নায়িকা নয়, বানিজ্যিক সিনেমার ভিলেনের সংলাপও বেশ ভাল লাগে আমার। যেমন ধরুণ- ওইদিন টেলিভিশন পর্দায় একটা সিনেমা দেখছিলাম যেখানে ভিলেন নায়িকার গায়ে হাত দিল। ব্যস সংগত কারনেই নায়িকা মহা উত্তেজিত। কম গেলেন না ভিলেন। চিৎকার করে বলতে থাকলেন-‘‘এই দুনিয়ায় এমন কোন গোলাপ নেই যে যার সুবাস আমি নেইনি। তোমাকেও আমি ছাড়ছি না সুন্দরী! কাছে আসো..!’’ এমন সংলাপের পর না হেসে পারা যায়? ব্যাপারগুলো সেন্স অব হিউমার দিয়ে দেখলেই মজা পাওয়া যায়।
একসময় ইচ্ছের বিরুদ্ধে অভিনয়ও করতে হয়েছে আমাকে। ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতা। দুটো নাটকে অভিনয় করেছি আমি। এর একটি ওভার বাউন্ডারি। অন্যটি দু’জনে। আসলে দুটো নাটকেই ক্রিকেটারের ভুমিকায় দেখা গেছে আমাকে। এটা পরিচালকের অনুরোধেই করতে হয়েছে। ক্রিকেটারের চরিত্র না হলে নিশ্চিত করেই করতাম না। ওসব আমাকে দিয়ে হতো না। তবে অভিনয়ের এই ব্যাপারটা অবশ্য বেগ উপভোগ করেছি । তাইতো ভবিষ্যতেও ব্যাটে-বলে মিলে গেলে নাটকে অভিনয় করতে চাই। তবে এক শর্ত -আসলে কোন ক্রিকেটারের ভুমিকায় আমি অভিনয় করতে চাই না। করতে চাই সম্পুর্ন এক এক চরিত্র। যা ব্যাক্তিগত জীবনে আমি নই। বলতে পারেন ব্যাপারটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেবো। হাসির নাটকই আসলে করতে চাই আমি। ক্রিকেটারের চরিত্রে তো সারা জীবনই অভিনয় করছি। এবার দেখি না অন্য কিছু পারি কীনা।
নাটক নয়, ঠিকঠাক মিলে গেলে বানিজ্যিক সিনেমাতে অভিনয়ের ইচ্ছেও আছে আছে আমার। তখন হয়তো আমাকেও বলতে হবে, ‘‘বৃষ্টি তুমি এতো সুন্দর কেন?’’ নাকি ভিলেন হতে হবে আমাকে? নায়িকা আমাকে দেখে বলবে ‘‘ছেড়ে দে শয়তান, তুই আমার দেহ পাবি কিন্তু আমার মন পাবি না?’’
নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন মজা করলাম। এভাবে আনন্দে থাকতেই ভাল লাগে আমার। দেখুন খেলোয়াড়ি জীবনে অর্জনের তালিকাটা কম দীর্ঘ নয়। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দীর্ঘ সময় খেলেছি। কতোশত ইতিহাসের যে সাক্ষী, হিসেব নেই। সেইসব স্মৃতিই আমাকে সারা জীবন অনুপ্রেরনা দেবে। মুখের এমন হাসি ম্লান হতে দেবে না কখনোই।
# জাভেদ ওমর বেলিম
(জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার)
Discussion about this post