ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের ঘাসে ঘষা সূর্যালোক, হালকা বাতাসে ভেসে বেড়ানো ইংলিশ গর্জন, আর মাঝখানে এক তরুণ ভারতীয় অধিনায়ক-শুবমান গিল। আজ ম্যাচের শেষ দিন। দল চাপে। দুই উইকেট পড়ে গেছে বিনা রানে, ইংল্যান্ডের চেয়ে পিছিয়ে থাকা ৩১১ রানে। তখন গিল ক্রিজে ছিলেন না শুধু রান করার জন্য, তিনি ছিলেন এক প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে। তাঁর ব্যাটে ছিল ভারতের আশা, এবং তাঁর মাথায় ছিল নেতৃত্বের প্রথম পরীক্ষার চাপ।
গিল খেললেন ধৈর্যের, জেদ আর সাহসের এক দুর্দান্ত ইনিংস। আগের দিন তিনি থেমেছিলেন ৭৮ রানে। সকালে নামলেন সাবধানী পায়ে, জানতেন একটা সেঞ্চুরি শুধু ব্যক্তিগত অর্জন নয়, এটা হবে এক ইতিহাসের জানালা খুলে দেওয়া। নব্বই ছুঁয়ে থেমে যাননি তিনি, থেমেছেন সময়কে ধরে রাখার জন্য। ৩৬ বল খেলেছেন পরের ১০ রান তুলতে। সেই অপেক্ষা ছিল গভীর, অস্থিরতাহীন, প্রজ্ঞায় পূর্ণ। শেষ পর্যন্ত ২২৮তম বলে পয়েন্টে ঠেলে তুলে নেন নিজের শতক। যেন নিজের দিক থেকে জানিয়ে দেন, নেতৃত্ব মানেই শৌর্য, কৌশল আর ক্লাস।
এই ইনিংসটি গিলের নেতৃত্বের অভিষেক সিরিজে চতুর্থ শতক। এর আগে ইংল্যান্ডের মাটিতে এক সিরিজে কেউ করেননি এত শতক। ক্রিকেট ইতিহাসে এই কীর্তির পাশে শুধু এক নাম-স্যার ডন ব্র্যাডম্যান। গিলের সেঞ্চুরির সংখ্যার চেয়েও বড় তার বিস্তৃতি, ব্যাটিংয়ের পরিণত রূপ, আর অসাধারণ সামঞ্জস্যতা।
এক সিরিজে ভারতের হয়ে চার শতক এর আগে পেয়েছিলেন কেবল সুনিল গাভাস্কার ও বিরাট কোহলি। গিল এই কাতারে তৃতীয় নাম হিসেবে এলেন, তাও অধিনায়ক হিসেবে! আর নেতৃত্বের প্রথম সিরিজেই এই কীর্তি, যা এর আগে কেউ করেননি-না ব্র্যাডম্যান, না কোহলি, না স্মিথ।
গিলের ব্যাট শুধু শতক এনে দেয়নি, রানের সুনামিও বইয়ে দিয়েছে। এখন পর্যন্ত তাঁর সংগ্রহ ৭২২ রান। নেতৃত্বের অভিষেক সিরিজে এত রান এর আগে করেছেন কেবল ব্র্যাডম্যান, যিনি করেছিলেন ৮১০। এখনো সিরিজে এক ম্যাচ বাকি। গিল যদি ওভালে করেন ৮৯ রান, তবে এই ‘ডন’কেও ছাড়িয়ে যাবেন।
এই সিরিজে তাঁর ইনিংসগুলো যেন প্রতিটাই ছিল ক্রিকেট সাহিত্যের আলাদা অধ্যায়। হেডিংলিতে ১৪৭ রানের ইনিংসে ছিল আত্মবিশ্বাসের আগুন। এজবাস্টনে এক ম্যাচে ২৬৯ ও ১৬১ রানে ছিল টেস্ট ইতিহাসে প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে দ্বিশতক ও দেড়শ ছোঁয়ার রেকর্ড। লর্ডসে একটিবার হোঁচট খেলেও, ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে এসে ফের মাথা উঁচু করে দাঁড়ালেন। এই জায়গাগুলোতেই বোঝা যায়, গিল শুধু প্রতিভা নয়, ধারাবাহিকতার প্রতিমূর্তি হয়ে উঠছেন।
শতকের পর বেশিদূর যেতে পারেননি—১০৩ রানে আউট হয়েছেন। কিন্তু ইনিংসটি যতটা বড় ছিল রানে, তার চেয়ে অনেক বড় ছিল তা আত্মবিশ্বাসে, কৌশলে, ও নেতৃত্বে। তার এই ইনিংস দলের পতন ঠেকিয়েছে, সেই সঙ্গে গড়েছে এমন সব রেকর্ড, যা অনেকের পুরো ক্যারিয়ারেও আসে না।
Discussion about this post