(১১ এপ্রিল ২০১৬, দৈনিক প্রথম আলোতে ছাপা হওয়া প্রতিবেদনটি ক্রিকবিডি২৪.কমের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল)
সাত আইকন খেলোয়াড়ের ডাক ছিল সবার শেষে। প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগের ‘প্লেয়ার ড্রাফট’জুড়ে তার আগ পর্যন্ত আলোচনায় ছয় ‘আইকন’। কারা সেই ‘আইকন’?
নামগুলো দেখুন—আকরাম খান, খালেদ মাহমুদ, জালাল ইউনুস, ইসমাইল হায়দার মল্লিক, আবদুল আউয়াল চৌধুরী ও সাইফুল আলম (স্বপন)। না, এই ছয়জনের কেউ এবার প্রিমিয়ার লিগে খেলছেন না! ‘প্লেয়ার ড্রাফটের’ তালিকায়ও তাঁদের নাম ছিল না। এঁরা সবাই বোর্ড পরিচালক এবং আলোচনাটাও সে কারণেই। কাল লা মেরিডিয়ান হোটেলের স্কাই বলরুমে আবাহনীর টেবিলে এই ছয় বোর্ড পরিচালকের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। কিছু সময়ের জন্য সেখানে বসেছিলেন বিসিবির আরেক পরিচালক কাজী ইনাম আহমেদও।
অন্য আরও দু-একটি ক্লাবের টেবিলেও দু-একজন পরিচালক ছিলেন। কিন্তু আবাহনীকে নিয়ে প্রশ্ন উঠছে ক্লাবটির টেবিলের প্রত্যেকেই বোর্ড পরিচালক বলে। একদিকে তাঁরা ক্লাবের প্রতিনিধি, অন্যদিকে বোর্ড পরিচালক—এই দ্বৈত ভূমিকায় অনিবার্যভাবেই স্বার্থের সংঘাত ঘটবে।
‘প্লেয়ার ড্রাফট’ শেষে সাংবাদিকেরা প্রশ্নটা তুললে বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান বিষয়টিকে একরকম উড়িয়েই দিয়েছেন, ‘গত দুবারের চ্যাম্পিয়ন দেখলে কিন্তু আপনাদের কথাটা মেলে না। তাহলে আবাহনী, মোহামেডান বা শেখ জামালেরই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কথা ছিল। সেটা তো হয়নি।’ আবাহনীর টেবিলে এত পরিচালকের উপস্থিতি নিয়ে তাঁর মন্তব্য, ‘সবাই যে আবাহনী থেকে এসেছেন তা-ও নয়। তাঁরা অন্য টেবিলেও বসতে পারতেন। এখন যদি সবাই জালাল ভাইয়ের সঙ্গে বসতে চায় এখানে কী করার আছে!’ কে কোন টেবিলে বসবেন সেটা নাকি উন্মুক্ত ছিল। লটারির সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক ছিল না।
কিন্তু জালাল ইউনুসের কথায় পরিষ্কার, আবাহনীর হয়ে এই ছয় পরিচালকের ‘প্লেয়ার ড্রাফটে’ অংশ নেওয়া পূর্বনির্ধারিত ছিল, ‘আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিল আমরা টেবিলে থাকব। চেষ্টা করব শক্তিশালী দল করতে।’ ক্লাব থেকে বোর্ড পরিচালক হওয়ায় ক্লাবের স্বার্থ দেখাটাকে নিজেদের দায়িত্ব মনে করেন আবাহনীর সর্বশেষ ক্রিকেট কমিটির চেয়ারম্যান। প্রায় একই কথা সর্বশেষ ক্রিকেট কমিটির যুগ্ম সম্পাদক ইসমাইল হায়দার মল্লিকেরও, ‘ক্লাব থেকেই আমি আজ বোর্ড পরিচালক। আমার কাছে ক্লাবের গুরুত্ব ক্রিকেট বোর্ড থেকেও বড়। ক্লাবের দায়িত্ব আমি এড়াতে পারি না।’
মজার ব্যাপার হলো, এ দুজনের কেউই কিন্তু আবাহনীর কাউন্সিলর হিসেবে বিসিবির নির্বাচন করেননি। নির্বাচনে আবাহনীর কাউন্সিলর ছিলেন বর্তমানে বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান ও শায়ান এফ রহমান। জালাল ইউনুস বিসিবির নির্বাচন করেছেন রায়েরবাজার অ্যাথলেটিক ক্লাব থেকে এবং ইসমাইল হায়দার ব্রাদার্স ইউনিয়নের কাউন্সিলর হিসেবে। তার মানে আবাহনীর সঙ্গে যত দীর্ঘ সময়েরই সম্পর্ক থাকুক না কেন, তাঁদের বিসিবি পরিচালক হওয়ার পথ করে দিয়েছে ওই দুই ক্লাব। কাজেই অন্তত বিসিবি-সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডে তাঁদের পরিচয়টা হওয়া উচিত রায়েরবাজার ও ব্রাদার্স কর্মকর্তা হিসেবেই।
সেটা কখনোই হয় না কারণ, নির্বাচনের আগে ওই সব ‘বন্দোবস্ত’ হয় সাময়িকভাবে। শুধু পরিচালকের পদ অলংকৃত করতেই রাতারাতি এক ক্লাবের সংগঠক হয়ে যান অন্য ক্লাবের কাউন্সিলর। নির্বাচনের পর হারিয়ে যায় সেই পরিচয়, বোর্ড পরিচালকের চেয়ারে বসে তাঁরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন আসল ক্লাবের স্বার্থ রক্ষায়। ‘প্লেয়ার ড্রাফটে’ আবাহনীর টেবিল তখন একসঙ্গে পেয়ে যায় ছয় পরিচালক।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা ও পাবনা জেলা ক্রীড়া সংস্থার কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচন করলেও আকরাম খান এবং সাইফুল আলমও (স্বপন) সংশ্লিষ্ট আবাহনীর সঙ্গে। প্রথমজন আছেন ক্রিকেট কমিটিতে, এবারের লিগে তাঁর আবাহনীর ম্যানেজার থাকার কথা। আর দ্বিতীয়জন তো সর্বশেষ ক্রিকেট কমিটির ভাইস চেয়ারম্যানই। তবে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ মনোনীত সাবেক খেলোয়াড় হিসেবে নির্বাচন করা খালেদ মাহমুদের উপস্থিতি স্বাভাবিকই ছিল আবাহনীর টেবিলে। প্রাইম ব্যাংক ক্রিকেটার্স ছেড়ে এবার যে তিনি আবাহনীর কোচ!
বোর্ড সভাপতিও বললেন…
বিতর্কিত ‘প্লেয়ারস বাই চয়েস’ বা ‘প্লেয়ার ড্রাফট’-এর ব্যাপারে এবার নেতিবাচক মনোভাব তুলে ধরেছেন স্বয়ং বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসানও। কাল ‘প্লেয়ার ড্রাফট’ শেষে তিনি বলেছেন, খেলোয়াড় দলবদলের জন্য এমন পদ্ধতি আদর্শ নয়।
‘আগে বলেছি, পরিস্থিতির কারণে এবার এভাবে হচ্ছে। তবে এটা স্থায়ী হতে পারে না। আমি এখনো মনে করি, এটা আদর্শ পন্থা নয়’—সাংবাদিকদের বলেছেন বোর্ড সভাপতি। তাঁর মতে, খেলোয়াড় দলবদলের ব্যাপারটা খেলোয়াড় এবং ক্লাবগুলোর ওপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত। তবে সভাপতির আশা, যেভাবেই দলবদল হোক, এখন থেকে লিগে খেলোয়াড়দের সঙ্গে ক্লাবগুলোর লিখিত চুক্তি থাকবে। লিখিত চুক্তি থাকার নিয়মটি এবারই প্রথম করল বিসিবি।
খেলোয়াড়দের স্বাধীনতা তো হরণ হয়-ই, ‘প্লেয়ার্স বাই চয়েসে’র মতো চাপিয়ে দেওয়া পদ্ধতি খেলোয়াড় দলবদলের উত্তাপটাও দেয় কমিয়ে। আগের নিয়মে দলবদলের সময় খেলোয়াড়দের কাছেই সবাই জানতে চাইত কে কোন দলে খেলছেন। অনেক খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রে শেষ মুহূর্ত পর্যন্তও বলার উপায় থাকত না কে কোথায় খেলবেন। আর এখন উল্টো খেলোয়াড়েরাই ফোন করে খবর নেন, ‘ভাই, আমাকে কোন দল ডাকল?’
ক্লাবগুলোর আর্থিক সংকটের কারণে ২০১২-১৩ মৌসুমে প্রথমবারের মতো প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগের দলবদল ‘প্লেয়ারস বাই চয়েস’ পদ্ধতিতে হয়। মাঝে এক মৌসুম আগের নিয়মে হয়ে এবারের দলবদলে আবারও ফিরেছে বিতর্কিত পদ্ধতিটি।
Discussion about this post