সেকান্দার আলী, সমকাল
কেউ বলছেন, ক্রিকেটের সূতিকাগার, কেউ বলছেন ভিত। ঢাকা ক্রিকেট লিগ নিয়ে এই মন্তব্য জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু ও কোচ নাজমুল আবেদীন ফাহিমের। তারা মনে করেন, ক্রিকেটের এই ভিত ধ্বংস হয়ে গেছে বিগত এক যুগের বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন ও পরিচালক ইসমাইল হায়দার মল্লিকের স্বেচ্ছাচারিতায়।
ঢাকা লিগের চারটি বিভাগে ( তৃতীয়, দ্বিতীয়, প্রথম বিভাগ ও প্রিমিয়ার লিগ) ‘ক্লাব বাণিজ্য’ গড়ে উঠেছে বিসিবি সভাপতির ছত্রছায়ায়। ভোট বাণিজ্য ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে ‘ক্লাব বাণিজ্য’ গড়ে তোলেন পাপনের আশীর্বাদপুষ্ট বেক্সিমকো ফার্মার কর্মকর্তা মল্লিক। সমকালের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগে ২২টি ক্লাবের মালিকানা তাঁর। আংশিক আর্থিক বিনিয়োগ করে আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা বেশির ভাগ ক্লাবের কাউন্সিলরশিপ নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন তিনি। ক্লাব ক্রিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের মতে, ক্লাব বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন মল্লিক। ভোটের লড়াইয়ে জোটবদ্ধ হতে বেক্সিমকো গ্রুপ আর গাজী গ্রুপও পিছিয়ে নেই। ছয়টি করে ক্লাবের মালিক তারা।
২০১২ সালে নাজমুল হাসান পাপন বিসিবির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হলে মল্লিক ক্রিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। নির্বাচনে ম্যানুপুলেট করে জয়ী হয়ে পরিচালনা পর্ষদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। শুরুর দিকে মল্লিক ক্রিকেটের উন্নতির জন্য কাজ করার মানসিকতা দেখালেও ধীরে ধীরে অনিয়ম করতে থাকেন। ঢাকা আবাহনী লিমিটেডকে চ্যাম্পিয়ন করাতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন মল্লিক। নিয়মের তোয়াক্কা না করে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বিভাগ বাছাই লিগে ক্লাব গড়ে তোলেন। আম্পায়ারদের ন্যক্কারজনকভাবে ব্যবহার করে নিজের দলকে ম্যাচ জেতাতেন।
বেক্সিমকো-সংশ্লিষ্ট একজন জানান, এ নিয়ে একবার শায়ান এফ রহমানের কাছে অভিযোগ করায় দুই পরিচালক খালেদ মাহমুদ সুজন এবং ওবেদ নিজামের ওপর চটেছিলেন মল্লিক। তিনি এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন, তৃতীয় বিভাগ বাছাই লিগের রেজিস্ট্রেশন ফি ৫ লাখ টাকা করেন। মল্লিক টাকা না দিয়ে ক্লাব রেজিস্ট্রেশন করাতে পারলেও অন্যদের পক্ষে সেটা সম্ভব হয়নি। এই বিভাগের ২০টি ক্লাবের মধ্যে ১১টির সরাসরি মালিক তিনি। ক্লাবগুলো হলো– পূর্বাচল স্পোর্টিং ক্লাব, প্যাসিফিক ক্রিকেট ক্লাব, ভাইকিংস ক্রিকেট একাডেমি, রেঞ্জার্স ক্রিকেট একাডেমি, ওল্ড ঢাকা ক্রিকেটার্স, রাইজিং স্টার ক্রিকেট ক্লাব, প্যারাডাইজ স্পোর্টিং ক্লাব, নাখালপাড়া স্পোর্টিং ক্লাব, রেজুলার স্পোর্টিং ক্লাব, আলফা স্পোর্টিং ক্লাব ও সাফিরে স্পোর্টিং ক্লাব। বাকি ৯টি ক্লাবের কয়েকটিতে বিনিয়োগ আছে তাঁর।
দ্বিতীয় বিভাগে উদয়াচল ক্লাব, গোপীবাগ ফ্রেন্ডস অ্যাসোসিয়েশন, গোল্ডেন ঈগলস স্পোর্টিং ক্লাব, ইয়াং প্যাগাসাস, ঢাকা ক্রিকেট একাডেমি, মোহাম্মদপুর ক্রিকেট একাডেমি, মোহাম্মদপুর ক্রিকেট ক্লাব ও বাংলাদেশ বয়েজ ক্লাবের কাউন্সিলরশিপ মল্লিকের হাতে। প্রথম বিভাগে শেখ জামাল ক্রিকেট একাডেমি, ঢাকা স্পার্টান ক্রিকেট ক্লাব, এক্সিওম ক্রিকেটার্স, ব্লুজ ক্রিকেটার্স তাঁর। প্রিমিয়ার লিগে আবাহনী ছাড়াও ব্রাদার্স ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণ মল্লিকের হাতে।
বেক্সিমকোর ক্লাবগুলো হলো– শাইনপুকুর ক্রিকেট ক্লাব, গুলশান ক্রিকেট ক্লাব, উত্তরা ক্রিকেট ক্লাব, ওল্ড ডিওএইচএস, নবাবগঞ্জ ক্রিকেট কোচিং একাডেমি ও বনানী ক্রিকেট ক্লাব। গাজীর দখলে থাকা ক্লাব– গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্স, রূপগঞ্জ ক্রিকেটার্স ক্রিকেট ক্লাব, গাজী টায়ার্স একাডেমি, লালমাটিয়া ক্লাব, কাকলী বয়েজ ক্লাব ও ঢাকা মেরিনার ইয়াংস ক্লাব।
বিসিবি সভাপতি পাপন প্রতিটি ক্লাবকে একটি করে কাউন্সিলরশিপ দেওয়ার অনুমোদন করিয়ে নিয়েছেন বার্ষিক সাধারণ সভায়। বোর্ড সভাপতির নেওয়া এই সিদ্ধান্ত ক্লাব দখলে আরও বেপরোয়া করে তোলে মল্লিককে। এতে করে ঢাকার ক্রিকেট লিগের সব বিভাগে মান পড়তে থাকে। খালেদ মাহমুদ সুজন ও মল্লিকের দৌরাত্ম্যের সঙ্গে পেরে না ওঠায় ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারেনি কোনো দল। মাঝে একবার শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব সৌভাগ্যক্রমে শিরোপা জিতেছিল মল্লিক-সুজনরা ছাড় দেওয়ায়।
এ ব্যাপারে কোচ নাজমুল আবেদিন ফাহিম বলেন, ‘ক্লাব ক্রিকেট ছিল দেশের ক্রিকেটের ভিত। লিগে খেলে যেমন অর্থ উপার্জন করত, তেমনি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ক্রিকেট খেলা হওয়ায় ভালো খেলোয়াড় তৈরি হতো। ফলে ওয়ানডে ফরম্যান্সে জাতীয় দল ভালো করত। কতিপয় কর্মকর্তার স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়মের কারণে ক্লাব ক্রিকেট ধ্বংসের মুখে। একজন ব্যক্তি ২২টি ক্লাবের মালিক। আট থেকে ১০টি ক্লাবে পরোক্ষভাবে আছে। তিনিই ঠিক করে দেন কে এবার ওপরের বিভাগে উঠবে, কে রেলিগেট হবে। এগুলো করা হয় ভোট বাণিজ্যের জন্য। লিগের চার বিভাগে ৭৬টি ক্লাব। এক ব্যাক্তির হাতে ৫০টি কাউন্সিলরশিপ থাকলে নির্বাচনে ম্যানুপুলেট করা খুবই সহজ। যে কাজটি গত তিন নির্বাচনে হয়ে এসেছে। ২০২৫ সালের নির্বাচনেও শতভাগ দখল রাখার পরিকল্পনা ছিল হয়তো।’ বৈষম্যবিরোধী ক্রিকেট সংগঠকরা চান স্বেচ্ছাচার মল্লিক-পাপনের বিচার।
মল্লিকের ক্লাব; প্রথম বিভাগ: শেখ জামাল ক্রিকেট একাডেমি, ঢাকা স্পার্টান ক্রিকেট ক্লাব, এক্সিওম ক্রিকেটার্স ও ব্লুজ ক্রিকেটার্স
দ্বিতীয় বিভাগ: উদয়াচল ক্লাব, গোপীবাগ ফ্রেন্ডস অ্যাসোসিয়েশন, গোল্ডেন ঈগলস স্পোর্টিং ক্লাব, ইয়াং প্যাগাসাস, ঢাকা ক্রিকেট একাডেমি, মোহাম্মদপুর ক্রিকেট একাডেমি, মোহাম্মদপুর ক্রিকেট ক্লাব ও বাংলাদেশ বয়েজ ক্লাব
তৃতীয় বিভাগ: পূর্বাচল স্পোর্টিং ক্লাব, প্যাসিফিক ক্রিকেট ক্লাব, ভাইকিংস ক্রিকেট একাডেমি, রেঞ্জার্স ক্রিকেট একাডেমি, ওল্ড ঢাকা ক্রিকেটার্স, রাইজিং স্টার ক্রিকেট ক্লাব, প্যারাডাইজ স্পোর্টিং ক্লাব, নাখালপাড়া স্পোর্টিং ক্লাব, রেজুলার স্পোর্টিং ক্লাব, আলফা স্পোর্টিং ক্লাব ও সাফিরে স্পোর্টিং ক্লাব
বেক্সিমকো গ্রুপ: শাইনপুকুর ক্রিকেট ক্লাব, গুলশান ক্রিকেট ক্লাব, উত্তরা ক্রিকেট ক্লাব, ওল্ড ডিওএইচএস, নবাবগঞ্জ ক্রিকেট কোচিং একাডেমি ও বনানী ক্রিকেট ক্লাব
গাজী গ্রুপ: গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্স, রূপগঞ্জ ক্রিকেটার্স ক্রিকেট ক্লাব, গাজী টায়ার্স একাডেমি, লালমাটিয়া ক্লাব, কাকলী বয়েজ ক্লাব ও ঢাকা মেরিনার ইয়াংস ক্লাব
# লেখাটি দৈনিক সমকাল থেকে নেওয়া
Discussion about this post