খেলা শেষে গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডের সামনে ড্রেসিংরুমের ধারে অটোগ্রাফ শিকারিরা যেভাবে ওত পেতে থাকে, কাল বিকেএসপির তিন নম্বর মাঠে লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের ড্রেসিংরুমের ঠিক ১০ গজ দূরে অবস্থান নিল জনা তিরিশেক যুবক।
এটুকু শুনে হয়তো ভাবছেন রূপগঞ্জ অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের অটোগ্রাফ নিতেই বুঝি অমন উত্সাহীদের জটলা। আসলে তা নয়, ওই জটলাকারীরা কারও অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য ভিড় করেনি। কেন করবে? তারা তো ক্রিকেট অনুরাগীই নয়। তাদের ঠিক সামনে দিয়ে ড্রেসিংরুম থেকে ৫-৭ গজ বাইরে হেঁটে গাড়িতে চেপে ঢাকার উদ্দেশে পাড়ি জমালেন সাকিব। রূপগঞ্জ ম্যানেজার সাব্বির আহমেদ রুবেলও দুই ভিনদেশি রায়ান টেন ডোশেট আর আসহার জাইদিকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। একে একে ক্রিকেটারদের অনেকেই তাদের জন্য রাখা মাইক্রোবাসের দিকে পা চালালেন। তাদের দিকে কারও চোখ পড়ল না। কেউ একটি কথাও বললেন না।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে পরিষ্কার হল তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। তারা লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের যুগ্ম সম্পাদক তারিকুল ইসলাম টিটুর অপেক্ষায়; কখন ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে আসেন। টিটু গাড়িতে বসামাত্র ছুটে এসে তার গাড়ি ঘেরাও করে ফেলল ওই যুবকের বহর। মুখে স্লোগান ও অশ্রাব্য গালাগাল।
কর্তব্যরত এক পুলিশ অফিসার তাদের নিবৃত্ত করার প্রাণপণ চেষ্টায় ব্যস্ত। ওই উত্তেজিত যুবকদের একটিই কথা-‘আমরা উনার (টিটুর) সঙ্গে কথা বলতে চাই।’ আর ক’জন হেড়ে গলায় বলে উঠলেন-‘মাফ চাইতে হবে। তার… (ছাপার অযোগ্য) বাদল (লুত্ফর রহমান বাদল) কেন বিসিবি সভাপতি ও অন্য কর্তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ করেছে? তার জন্য সরি বলতে হবে।’
এভাবেই চলল বেশ কয়েক মিনিট। ওই উত্তেজক যুবকরা বারবার তারিকুল ইসলাম টিটুকে গাড়ি থেকে নামিয়ে বাইরে টেনে আনার চেষ্টায় ব্যতিব্যস্ত। টিটু বেগতিক দেখে গাড়ির দরজা লক করে দেন। এর মধ্যে দুই যুবক ড্রাইভার ও তার সামনের সিটের কাচ দিয়ে হাত গলিয়ে সে লক খোলার চেষ্টা করল। কর্তব্যরত পুলিশ কর্তা অবশ্য কিছুতেই টিটু যে গেটের সামনে বসেছেন, সে জায়গা ছাড়েননি। তার সঙ্গে ধস্তাধস্তি না করলেও ওই যুবকরা বারবার টিটুকে নামিয়ে দেওয়ার দাবি জানাল। ঘুরে-ফিরে তাদের কথা দুটি-
এক. টিটুকে গাড়ি থেকে নেমে তাদের সঙ্গে কথা বলতে দিতে হবে।
দুই. তাকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। টিটুর অবস্থা তখন সঙ্গীন। ওই উত্তেজক যুবকরা কতটা বেপরোয়া ও উচ্ছৃঙ্খল-তার প্রমাণ মিলবে একটি উদাহরণে-বিকেএসপি মাঠে উপস্থিত দুটি টিভি চ্যানেলের ক্যামেরা টিটুর গাড়ির দিকে তাক করা। তিন-চার ফটোসাংবাদিক তাদের পাশে চেয়ার পেতে দাঁড়িয়ে ওই উচ্ছৃঙ্খলতা আর অরাজকতাকে ক্যামেরাবন্দি করছিলেন। কিন্তু তাতে কি? ওই যুবকদের ভাবখানা এমন-আমরা যা খুশি করব। কেউ ক্যামেরাবন্দি করলে করুক।
তবে অনেক ধস্তাধস্তির পরও যখন টিটুকে গাড়ি থেকে বের করা যাচ্ছিল না তখন তারা আরও বেপরোয়া। এভাবেই প্রায় আধঘণ্টা কাটল। একসময় মোহামেডান ড্রেসিংরুমের সামনে জটলা করে থাকা ঢাকা থেকে আসা সাত-আটজন সমর্থকর ছুটে এলেন টিটুর গাড়ির সামনে। তারাও ওই কর্তব্যরত পুলিশ কর্তার আশপাশে গিয়েই অবস্থান নিলেন। কয়েক মিনিট পর মোহামেডান ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে এলেন মোহামেডান তথা বাংলাদেশ ওয়ানডে স্কোয়াডের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা, কর্মকর্তা মাহবুব রব ও জিয়াউর রহমান তপু।
মাশরাফিকে দেখেই যুবকদের উত্তেজনা খানিক প্রশমিত হল। মাশরাফি দূর থেকেই বলে উঠলেন-‘ভাই, সরি। গাড়িটা যেতে দেন।’ কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল যুবকদের পাল্টা জবাব-‘মাশরাফি ভাই, আপনি কেন সরি বলছেন? ঘটনা তো আর আপনার সঙ্গে হয়নি।’
তবুও নাছোড়বান্দা মাশরাফি। তাদের বোঝালেন, এভাবে কাউকে টানাহেঁচড়া করে গাড়ি থেকে নামানোর চেষ্টা মোটেই ভালো দেখায় না। এটা ভদ্রতা ও শিষ্টাচারের বাইরে। কয়েক মিনিটের মধ্যে উত্তেজনা কমল। মাশরাফির উপস্থিতিতেই টিটুর গাড়ি ঘিরে থাকা যুবকরা হঠাত্ ‘মোহামেডান-মোহামেডান’ স্লোগান দিয়ে বেরিয়ে গেল।
‘মোহামেডান’ ধ্বনির কথা শুনে মনে হতেই পারে সাদা-কালো শিবিরই বুঝি এ ঘটনা ঘটিয়েছে। বিষয়টি মোটেই তা নয়। ওই যুবকরাই নিজেদের পরিচয় দিয়েছে। তারা কারা? জানতে চাওয়া হলে বললেন-‘আমরা বিসিবির লোক।’
তাকে কারা জোর করে গাড়ি থেকে নামানোর চেষ্টা করেছে, তারা কারা? তাদের উদ্দেশ্য কী?
তারিকুল ইসলাম টিটুর দাবি-‘মাঠের খেলা টেবিলে চলে গেছে। টেবিলেই হয়েছে এমন ঘৃণ্য ও জঘন্য ঘটনার নকশা।’
কারা এটা ঘটিয়েছে? জানতে চাওয়া হলে টিটু সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপনারাই তো দেখেছেন এরা কারা। কী তাদের উদ্দেশ্য। এটুকু বলতে পারি, যারা আমাকে নাজেহাল করেছে তারা কেউ মোহামেডানের সমর্থক নয়। আমি সেই ১৯৮৬ সাল থেকে মোহামেডানের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত। মোহামেডান সমর্থকরা আমাকে চেনে। যারা করেছে, তাদের আমি চিনি না। তবে তাদের কারা পাঠিয়েছে তা বুঝতে পারছি। আমি জীবনের শঙ্কায় ভুগছি। কর্তব্যরত পুলিশ এবং মাশরাফি এগিয়ে এসেছে আমাকে উদ্ধারের জন্য। আমার নিন্দা জানানোর ভাষা নেই। আমি হতবাক। স্তব্ধ।’
টিটু এর বেশি কিছু বলতে না চাইলেও এর সঙ্গে লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জ অধিপতি লুত্ফর রহমান বাদল ক’দিন আগে বোর্ডপ্রধান ও বোর্ড পরিচালকদের উদ্দেশে যে বল্গাহীন মন্তব্য করেছেন, এটা তারই জের। কারণ ওই উত্তেজক যুবকরা বারবার বাদলের আচরণ ও কথাবার্তার জন্য টিটুকে মাফ চাইতে বলেছে। কর্তব্যরত পুলিশ কর্তা কার্যকর ভূমিকা রেখে টিটুকে লাঞ্ছিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। তবে ওই সময় মাত্র চারজন পুলিশ ছিলেন। পর্যাপ্ত পুলিশ থাকলে ওই উচ্ছৃঙ্খল যুবকরা রূপগঞ্জ ড্রেসিংরুমের সামনেই আসতে পারত না।
এছাড়া বিকেএসপির নিরাপত্তা কর্মীদের বেষ্টনী ভেদ করে ওই যুবকরা বাসে করে কীভাবে মাঠে ঢুকল সে প্রশ্নও বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
×প্রতিবেদনটি ৭ ডিসেম্বর দৈনিক সকালের খবরে ছাপা হয়েছে
Discussion about this post