সেকান্দার আলী
কোচ ও মেন্টর; দুই ভূমিকাতেই সুখ্যাতি আছে খালেদ মাহমুদ সুজনের। সংগঠক হিসেবেও দারুণ সফল তিনি। বিসিবি গেম ডেভেলপমেন্ট বিভাগকে সাজিয়েছেন নিজের মতো করে। বাংলাদেশের মানুষকে দিয়েছেন যুব বিশ্বকাপ ও যুব এশিয়া কাপ জয়ের স্বাদ। খেলোয়াড়ি জীবন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত এত কিছু করেও সুজন কেন সমালোচিত? কেনইবা বিতর্ক মাথায় নিয়ে বিসিবি ছাড়তে হলো?
প্রশ্নগুলোর উত্তর হয়তো ক্রিকেট-সংশ্লিষ্টদের জানা। ঢাকার ক্লাবপাড়ায় সুজন সমালোচিত লিগ কাঠামো ধ্বংস করার অভিযোগে। তৃতীয় বিভাগ বাছাই থেকে শুরু করে প্রিমিয়ার লিগে ঘটে যাওয়া বেশির ভাগ খারাপের সঙ্গে বিসিবির সাবেক এ পরিচালক আছেন বলে দাবি ক্লাব সংগঠকদের। অনেক বছর ধরে অভিযোগ ছিল, উঠতি ক্রিকেটারদের নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। রাজশাহীর ক্রিকেট একাডেমি বাংলা টাইগার্সের ক্রিকেটারদের বয়সভিত্তিক দলে নেওয়ার বিষয়টি বহুল চর্চিত। সুজনের সব ভালো কাজকে অনিয়মের অভিযোগ ও স্বার্থ সংঘাত ম্লান করে দিয়েছে বলে মনে করা হয়।
# সুজন (খালেদ মাহমুদ) ও মল্লিকের (ইসমাইল হায়দার) ইশারায় বাংলাদেশের ক্রিকেট চলত।
# কিছু খেলোয়াড় আছেন, তাদের অন্য ক্লাবে খেলতে দিতেন না।
# ক্রিকেটারদের ঠিকমতো সম্মানী দেওয়া হতো না।
# নিজে দুটি দল বানাতেন– আবাহনী ও শাইনপুকুর। অন্য দলগুলোকে শক্তিশালী হতে দেননি।
# আম্পায়ার, ম্যাচ রেফারি, কিউরেটর সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি
# কিছু খেলোয়াড় ও কোচ মিজানুর রহমান বাবুল তাঁর (সুজন) পক্ষে কাজ করতেন
আবাহনী ও বেক্সিমকো গ্রুপের কোচ, বিসিবি পরিচালক হিসেবে নাজমুল হাসান পাপনের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস দেখাননি পরিচালকরাও। আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে পাপনের বোর্ডের পতনে আলোচনায় সুজনের গত ১১ বছরের কর্মকাণ্ড। তিনি অবশ্য পরিচালকের পদ ছেড়ে দিয়ে নীরবতা পালন করছেন। অথচ ক্ষমতায় থাকাকালে মাঠে, মাঠের বাইরে উচ্চবাচ্য করতে দেখা গেছে তাঁকে।
সুজনের কূটকৌশলেই তৃতীয় বিভাগ বাছাই লিগ বন্ধ করা হয়। গুঞ্জন আছে, তাঁর পরামর্শেই প্রথম ও দ্বিতীয় বিভাগ লিগের কাঠামো ধ্বংস করেছেন ইসমাইল হায়দার মল্লিক ক্লাব বাণিজ্যের সুবিধার্থে। জাতীয় দলের সাবেক এক অধিনায়ক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বয়সভিত্তিক দল থেকে শুরু করে নিচের লিগে বাংলা টাইগার্সের ক্রিকেটারদের সরবরাহ করতেন তিনি।’
লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের ম্যানেজার সাব্বির আহমেদ রুবেল বলেন, ‘ক্রিকেটার, অধিনায়ক ও কোচ সুজন ভাইকে নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু সংগঠক ও বেক্সিমকোর কোচ হিসেবে তিনি যেভাবে ঢাকা লিগ শেষ করে দিয়েছেন, তা ক্ষমার অযোগ্য। আম্পায়ার, ম্যাচ রেফারি, কিউরেটর সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। এককথায় ঢাকা লিগ ধ্বংস করে দিয়েছেন তিনি। জাতীয় দলের সাবেক একজন অধিনায়কের কাছে আমরা এগুলো আশা করি না। খেলা নিয়ে সব খারাপ পথ মল্লিককে দেখিয়েছেন তিনি।’
বিকেএসপির মাঠে আবাহনীর খেলা হতো বেশি। প্রতিপক্ষ দলগুলো ওই ভেন্যুতে অনিরাপদ মনে করেছে বরাবরই। এই মাঠে খেলা চলাকালে আম্পায়ার ও প্রতিপক্ষ দলের কর্মকর্তাদের হুমকি-ধমকি দিয়ে কোণঠাসা করে ফেলা ছিল সুজনের নিত্যদিনের ঘটনা। তাঁর প্রভাবে পরাজয় নিশ্চিত জেনে ম্যাচ খেলতে অস্বীকৃতি এবং পয়েন্ট ভাগাভাগির ঘটনাও ঘটেছে।
বিসিবি থেকে সুজনের বিদায়ের পর মোহামেডানের ক্রিকেট কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম টিটুর মন্তব্য ছিল এমন, ‘রাহুমুক্ত হলো দেশের ক্রিকেট।’ তিনি বলেন, ‘সুজন (খালেদ মাহমুদ) ও মল্লিকের (ইসমাইল হায়দার) ইশারায় বাংলাদেশের ক্রিকেট চলত। কিছু খেলোয়াড় আছেন, তাদের অন্য ক্লাবে খেলতে দিতেন না। তাঁর পছন্দমতো দলে খেলাতেন। ছেলেগুলো বঞ্চিত হয়েছেন, ঠিকমতো সম্মানীর টাকাও পাননি। তারা ভয়ে খেলেছেন। এখন ওই ছেলেগুলো মুক্ত হয়ে গেল।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রিমিয়ার লিগে তিনি দুটি দল বানাতেন– আবাহনী ও শাইনপুকুর। অন্য দলগুলোকে শক্তিশালী হতে দেননি কখনোই। এই সুজনের জন্য কিছু কিছু ক্লাব খেলোয়াড় নিতে পারেনি। এখন দেখা যাবে, সুজনের জোর কতটুকু। তাঁর কোচিংয়ে বছর বছর আবাহনী চ্যাম্পিয়ন হয় কিনা। তিনি আসলে ক্রিকেটের সবকিছু নষ্ট করে দিয়ে গেছেন।’
প্রাইম দোলেশ্বরের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুস্তাক হোসেনের অভিযোগ আরও মারাত্মক। দোলেশ্বরের কোচ মিজানুর রহমান বাবুলকে ব্যবহার করতেন আবাহনীকে চ্যাম্পিয়ন করাতে, ‘ক্লাবগুলোর মধ্যে প্রাইম দোলেশ্বর ও লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জ খালেদ মাহমুদ সুজনের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। তবে আমাদের দলের কয়েকজন খেলোয়াড় ও কোচ ছিলেন, যারা তাঁর (সুজন) পক্ষে কাজ করতেন। প্রাইম ব্যাংক বা শেখ জামাল ক্লাবের সঙ্গে ম্যাচ থাকলে কোচ মিজানুর রহমান বাবুল হারানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে যেতেন। আমি বলতাম হারান। অথচ আমরা জিতলে আমাদের কোনো লাভ হতো না। লাভ হতো আবাহনীর।’
আবাহনীর কোচ সুজনের বিরুদ্ধে মুস্তাকের অভিযোগের শেষ নেই। এ নিয়ে কোচ বাবুল প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘ম্যাচ হারলেই এসব বলা হতো। কোনো প্রমাণ থাকলে তাঁকে দেখানোর অনুরোধ জানাচ্ছি।’ বাবুল প্রতিক্রিয়া জানালেও সুজন যে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। কল করে, ম্যাসেজ দিয়েও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি তাঁর কাছ থেকে।
সূত্র: দৈনিক সমকাল
Discussion about this post