ফোনে যখন কথা বলছিলেন, পাশ থেকে রিনরিনে একটা মধুর কণ্ঠ ভেসে এল-আব্বু, আমার কাছে এসো!
আস্তে আস্তে করে কী যেন বললেন। তারপর হেসে বললেন, ‘এই এখন আমার পরিবার। আমার সংসার, আমার জীবন, আমার অবসর; সবই এই যার গলা শুনলেন সেই। এই আমার সন্তান। এই আমার বন্ধন।’
হ্যাঁ, ক’বছর আগেও লম্বা চুল, মারকুটে ব্যাটিং দিয়ে শত শত তরুণীর হূদয়ে ঝড় তোলা সেই শাহরিয়ার নাফীস এখন আটকে গেছেন শাহওয়ার আলী নাফীস নামে অবিশ্বাস্য এক বাঁধনে। যে বাঁধন যতই শক্ত হয়, ততই মধুর। সেই বাঁধনে আটকা পড়ে রোমান্টিক মানুষটি এখন স্রেফ সংসারি।
চেহারায়-পোশাকে-চুলে একটা ‘হার্টথ্রব’ ব্যাপার থাকলেও শাহরিয়ার নাফীস কখনই ঠিক বল্গাহীন ছিলেন না। ক্রিকেট খেলার পাশাপাশি যেটুকু সময় দিতেন, সেটা পরিবারকেই। বাইরে তেমন আড্ডাও ছিল না, সেভাবে প্রেম-ট্রেম করার সুযোগও হয়নি।
বন্ধুদের নিয়ে বাসাতেই আড্ডা দিতেন। নিজেই সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বললেন, ‘আমি চিরকালই একটু ঘরকুনো টাইপের ছেলে। পড়াশোনা আর ক্রিকেটের বাইরে বাসা থেকে তেমন বেরোতাম না। বন্ধুদের বাসায় আসতে বলতাম, ওখানেই আড্ডা হতো।’
এমন ছেলের আবার প্রেম হয় কী করে!
হয়, হয়। আরব্য রজনীর বন্দি নায়িকা পর্যন্ত প্রেম করে ফেলে, আর তো ‘ঘরকুনো’ শাহরিয়ার নাফীস! আসলে অনেকটা ঘরে বসে বসেই প্রেম হয়ে গেল নাফীসের। নায়ক আমাদের বাঁহাতি জাতীয় দলের ওপেনার। আর এখানে নায়িকার নাম-ইশিতা তাসমি; বর্তমানে পুরোদস্তুর আইনজীবী।
ইশিতা ছিলেন নাফীসদের পারিবারিক বন্ধুর মতো। বাবা-মায়ের সূত্রে দুই পরিবারে যাতায়াত ছিল, সেখানে সেই ছোটবেলা থেকেই নাফীস-ইশিতার পরিচয়। কিন্তু বাল্যপ্রেম হয়নি; তখন প্রেম ব্যাপারটা বোঝার বয়স হয়নি আর কী! সেটা হল এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে নাফীসের কিছু বন্ধুর সঙ্গে দেখা গেল ইশিতার বেশ ভালো বন্ধুত্ব। বন্ধুর বন্ধু মানে বন্ধু! সেই সুবাদে পুরো বন্ধুত্বটা ঝালাই হল। এবং ঝালাই হতে হতে কখন যেন প্রেমই হয়ে গেল। সেটা যে ঠিক কীভাবে হল, তা আর কেউ বলতে পারেন না।
আসলে প্রেম তো এভাবে বলেকয়ে আসে না। কীভাবে যেন হয়ে যায়। ২০০৫ সালের ঘটনা। দুজনই টের পেলেন, পরস্পরকে ছাড়া আর চলবে না; মানে প্রেমটা হয়েই গেছে।
-তারপর? কে আগে প্রস্তাব দিলেন?
দুজনই অন্যের ঘাড়ে ‘দায়’ চাপাতে চান। আর চলে হাসির ফোয়ারা।
আচ্ছা, প্রস্তাবের ব্যাপারটা না হয় বোঝা গেল। তাহলে প্রেম জমল কেমন? ওই যে যাকে বলে একসঙ্গে একটু আড্ডা, হাতে হাত রেখে বসে থাকা, চুপচাপ আকাশ দেখা; এসব হল না? ধুর। সময় কই? আর উপায় কই!
শাহরিয়ার নাফীস বুঝিয়ে বললেন, ‘তখন আমি ক্রিকেট আর পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যস্ত। সে-ও পড়াশোনায় ব্যস্ত। তখন ওসব আড্ডার সময় কই? যা একটু-আধটু কথাবার্তা হতো, ওতেই সব হয়ে গেল।’ আরেকটা সমস্যাও ছিল। নাফীস ততদিনে তারকা হয়ে গেছেন। তাই টিএসসি বসে আড্ডা দেওয়া, বাদাম খাওয়া; এসব করার ঠিক উপায়ও ছিল না।
আর এদের সবকিছু এমন বুলেটের গতিতে যে, সেই সাদাকালো যুগের হাতে হাত রেখে ভালোবাসার সময় ছিল না। ২০০৫ সালে প্রেম, ২০০৬ সালের ১ নভেম্বর বিয়ে! হ্যাঁ, ভালো করে বুঝে ওঠার আগেই সবাই জানতে পারলেন, শাহরিয়ার নাফীস বিয়ে করে ফেলেছেন।
পারিবারিকভাবে বিয়েটা তেমন উচ্ছ্বাসের হয়নি। তেমন সাড়ম্বরেও হয়নি। একটা কারণ ছিল, তখন বিশ্বকাপ এবং জিম্বাবুয়ে সফর নিয়ে নাফীসের ব্যস্ততা। এর মধ্যেই জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের নিয়ে ঘরোয়া পরিবেশে হয়ে গেল বিয়ের অনুষ্ঠান।
তখন জাতীয় দলটাই একটা পরিবার। তারা সবাই মিলেই বিয়েটাকে উত্সবে পরিণত করে ফেলেছিলেন। একটা লোকের ভূমিকার কথা কিছুতেই ভুলতে পারেন না নাফীস-হাবিবুল বাশার। নাফীস আবেগ ধরা গলায় বলছিলেন, ‘সুমন ভাই একেবারে আক্ষরিক অর্থে আমাদের ক্যাপ্টেন ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ক্যাপ্টেন্সি শুধু মাঠে হয় না। মাঠের বাইরে আমাদের ব্যক্তিগত সমস্যাগুলোও সুমন ভাই সমাধানের চেষ্টা করতেন। আমার বিয়েতে তিনি অভিভাবকের মতো ভূমিকা পালন করেছিলেন। তখন আমার বারবার মনে হচ্ছিল, দিস ইস আ ক্যাপ্টেন।’
বিয়ে হয়ে গেল। হঠাত্ শাহরিয়ার নাফীসের ব্যাটে রান ফুরিয়ে গেল যেন। তারপর আইসিএল, নিষেধাজ্ঞা, পারিবারিক সঙ্কট; কত শত সমস্যার ভেতর দিয়ে গেছেন নাফীস। আজ পেছন ফিরে দেখলে বোঝেন, সেই সময়ে একটা মানুষের সমর্থন বিনাশর্তে পেয়ে গেছেন-স্ত্রী ইশিতা।
কথা বলতে গিয়ে মেনে নিলেন, ‘আমার জীবনের সম্ভবত ওই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। আমাকে বলতে পারেন ওর ওপর নির্ভরশীল একজন মানুষ। আমার সেই সময়টায় যে সমর্থন দিয়েছে, সেটা অকল্পনীয়।’
দুঃসময়টা পার করে এসেছেন। আবার তিনি জাতীয় দলে। এখন কোলজুড়ে, ঘরজুড়ে রাজত্ব করে বেড়ায় শাহওয়ার। এই সময়ের বদলের সঙ্গে সঙ্গে জীবনের আরেকটা বড় বদল দেখে ফেলেছেন শাহরিয়ার নাফীস। একটু দার্শনিক ভঙ্গিতে বললেন, ‘মানুষের জীবনের নিউক্লিয়াসটা সময়ে সময়ে বদলায়। আমার জীবনের এখন সব স্বপ্ন ঘুরপাক খায় ছেলেটাকে নিয়ে। যেটুকু সময় পাই ওর সঙ্গেই কাটাই।’
-কীভাবে?
শাহরিয়ার-শাহওয়ার একসঙ্গে ভিডিও গেম চলে, ক্রিকেট চলে, চলে কার্টুন দেখার প্রতিযোগিতা। নাফীস হেসে বলেন, ‘ওর জন্মের পরপর নানা কারণে ওর আম্মু ওকে একটু কম সময় দিতে পেরেছে। আমি আবার ওই সময়ে বেশ সময় দিয়েছি। ফলে ওর খাওয়া-গোসল; সবই আমার হাতে।’
কিন্তু আব্বু যে জাতীয় দলের ক্রিকেটার! আব্বুকে তো সবসময় কাছে পাওয়া যায় না। এখন শাহওয়ার এই বাস্তবতাটা বুঝতে শিখছে। এখন বাসায় ফিরলে জোর গলায় বলে ওঠে, ‘আব্বু তোমাকে টিভিতে দেখেছি। তুমি ভালো খেলেছ।’
এর চেয়ে বড় সার্টিফিকেট একজন মানুষের জীবনে আর দরকার হয় না।
Discussion about this post