ফিলিপ হিউজ- যেন তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্ভাগা এক ক্রিকেটার। ২০১৪ সালের ২৭ নভেম্বর যিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তার চলে যাওয়ার আরো একটি বছর পেরিয়ে গেল।
২৬তম জন্মদিনের কেক কাটার তিন দিন আগেই শেষ তার জীবনের অধ্যায়।
তিনি ফিরবেন না এমন একটা আশঙ্কার কু-বাতাস বইছিল ২০১৪ সালের ২৫ নভেম্বর থেকেই। ঘটনা মাসের মঙ্গলবারের। সিডনিতে চলছিল অস্ট্রেলিয়ার শেফিল্ড শিল্ডের ম্যাচ। সাউথ অস্ট্রেলিয়ার প্রতিপক্ষ নিউ সাউথ ওয়েলস। উইকেটে তখন দারুণ ব্যাট চালাচ্ছিলেন ফিল হিউজ। ৬৩ রানে অপরাজিত। এ ইনিংস যেন ৪ ডিসেম্বর শুরু হতে যাওয়া ব্রিসবেন টেস্টের টিকেট। ভারতের বিপক্ষে মাইকেল ক্লার্কের জায়গায় তার খেলাটা প্রায় নিশ্চিত। ঠিক তখনই ঘটে গেল দুর্ঘটনা! প্রতিপক্ষের অলরাউন্ডার শন অ্যাবটের একটি শর্ট পিচ বল হুক করতে গেলেন হিউজ। বলে ব্যাটে সংযোগ হল না। ৫ আউন্সের সেই কোকাবোরা বল আঘাত হানল তার হেলমেটের পেছনে খোলা জায়গায়, কানের ঠিক নিচে। ব্যস, তখনই সবশেষ! কয়েক সেকেন্ড শুধু দাঁড়িয়ে থাকলেন। এরপর মাঠেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলেন। হতবিহ্বল সতীর্থরা। মাঠ থেকে সোজা অ্যাম্বুলেন্সে সিডনির সেন্ট ভিনসেন্ট হাসপাতালে।
এরপর ৬০ ঘণ্টার মতো চেষ্টা চালিয়েছেন ডাক্তাররা। জরুরি অস্ত্রোপচার করে হিউজকে রাখা হয়েছিল নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে। কিন্তু কাল সকালে সেখানেই তার অবশ হয়ে আসা শরীর থেকে শেষ নিঃশ্বাসটুকুও বেরিয়ে গেল। ডাক্তাররা বললেন-হৃদপিণ্ড থেকে মস্তিষ্কের রক্ত চলাচলের যে শিরা আছে সেটি ছিঁড়ে গেছে হিউজের।
বয়স ২৫, খেলেছেন ২৫ ওয়ানডে আর ২৬ টেস্ট। পুরো ক্যারিয়ারটাই পড়ে রয়েছিল তার। আর তখনই অসময়ে তার মৃত্যু নাড়িয়ে দিয়েছে গোটা ক্রিকেটবিশ্বকে। সিডনির হাসপাতালে যেখানে হিউজের মরদেহ রাখা সেখান থেকে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বের হলেন ডেভিড ওয়ার্নার। ছিলেন ব্রাড হাডিন, স্টিভেন স্মিথ, ম্যাথু ওয়েড, জর্জ বেইলি, শেন ওয়াটসন, পিটার সিডল, মিচেল স্টার্ক, ফিল জ্যাকস, অ্যারন ফিনচ, কোচ ড্যারেন লেম্যান। দেখা মিলল সাবেক ক্রিকেটার স্টিভ ওয়াহ ও রিকি পন্টিং, ব্রেট লিরও। স্তিমিত, বাকরুদ্ধ সবাই! এভাবে একজন হারিয়ে গেলে কিছু বলার আর থাকে কি!
হিউজের পরিবারের পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্যে পড়েন মাইকেল ক্লার্ক। বললেন, ‘আমাদের প্রাণপ্রিয় ছেলে এবং ভাই ফিলিপের মৃত্যুতে আমরা শোকে স্তব্ধ। হিউজ তোমাকে আমরা মিস করব, তোমাকে আমরা ভুলব না।’ এ কথাগুলো বলতে গিয়ে বারবারই গলা আটকে যাচ্ছিল অজি অধিনায়কের। হিউজের বাবা গ্রেগ, মা ভার্জিনিয়া, ভাই জেসন ও বোন মেগান তো গত কয়েক দিন ধরে কথা বলতেই ভুলে গেছেন। নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকছেন শুধু।
আরেকজন মানুষ বোবা হয়ে গেছেন। কী বলবেন, কী করবেন তিনি যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। পরশু সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ালেন। আর কাল সকাল থেকেই হাসপাতালে, বন্ধুর পাশে। শন অ্যাবট-তার বাউন্সারই যে জন্ম দিল এ ট্র্যাজেডির। কিন্তু কোনোভাবেই তাকে দায়ী করার ন্যূনতম সুযোগ নেই। বাউন্সার ছোড়া তো পেসারদের রুটিনওয়ার্ক। এ ক্ষেত্রে একশ’র মধ্যে ৯৯ বারই অজি ব্যাটসম্যানরা বাউন্ডারি হাঁকান, নয়তো মাথা নিচু করে বল ছেড়ে দেন। কিন্তু বেচারা অ্যাবট পুড়ছেন অনল দহনে। হিউজের পরিবারের মানুষদের চেয়েও তার যন্ত্রণা কোনো অর্থে কম নয়। বরং এখানে ‘অপরাধ’ নামের একটা ব্যাপার তাড়া করছে তাকে।
তাহলে এমন মৃত্যুর জন্য কে দায়ী? ক্রিকেট? না, তাও নয়। সবই নিষ্ঠুর নিয়তি!
সিডনির এ দুঃখজনক ঘটনা মনে করিয়ে দেয় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে রমন লাম্বার ট্র্যাজেডি। মাথায় বলের আঘাত পেয়ে মাত্র ৩৮-এ শেষ ভারতীয় ক্রিকেটার লাম্বার জীবনের ইনিংস।
হিউজ ফিরে গেলেন ২৫-এ। সৌরভ ছড়ানোর আগেই ঝরে গেল আরেকটি ‘ক্রিকেট ফুল’!
Discussion about this post