লুৎফর রহমান বাদলের কলাম
শনিবার সকাল এমন একটা মর্মান্তিক খবর নিয়ে অপেক্ষায় ছিল কে জানতো? ভাবতেও পারিনি সাজ-সকালেই এভাবে এলোমেলো হয়ে যাবো। হদয় ভাঙ্গা এক সংবাদ আমাকে পুড়িয়ে মারবে।
কথায় আছে দুঃসংবাদ নাকি বাতাসের আগে ভেসে আসে! তাই হলো। শুনলাম ‘আরাফাত রহমান কোকো আর নেই!’ শুরুতে তো বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। টেলিভিশনের পর্দায় ব্রেকিং নিউজটা দেখেও সেই অবিশ্বাসের দোলায় দুলতে থাকলাম। দু’চোখ ঝাপসা হয়ে এলো আমার! স্বজন হারালেই বুঝি এমন হয়।
কিন্তু এ কী করে হয়, এত্তো আগে চলে যাবে কোকো? আমার সময় বয়সী। দু’জনের কতো-শত স্মৃতি। দিনের পর দিন আড্ডা আর ক্রিকেট নিয়ে কতো তর্ক-বিতর্ক আর পরিকল্পনা।
এসব ভাবতে ভাবতেই ফিরে গেলাম আরো পেছনে। যেখানে আমাদের বন্ধুতার শুরু। অনেক অনেক বছর আগের কথা। প্রধানমন্ত্রী আর স্বাধীনতা ঘোষকের ছেলে- ভেবেছিলাম কোকো হয়তো আমাদের মতো কাউকে পাত্তাই দেবে না। কিন্তু কাছে যেতেই ভুল ভাঙ্গল। এতো বড় একটা পরিবারের ছেলে হয়েও কতো নিরহংকারী! সহজ-সরল! ভাবাই যায়না।
কথা বলতেই বুঝতে পারলাম ক্রিকেট নিয়ে তার জ্ঞান অপরিসীম। খেলাটির প্রতি দারুণ আগ্রহ। ক্রিকেটকে এগিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনাও জানা আছে তার। কিন্তু নিজের এই গুন গুলো আড়াল করে রাখতেই ভালবাসতেন স্বল্পভাসী এই মানুষটি।
২০০২ সালে তাকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড থেকেই তাকে আমন্ত্রন জানানো হল। ডেভলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান হলেন তিনি। এরপরই আসলে বেরিয়ে আসল তার প্রতিভার স্ফুরন। আমরা পেলাম সফল এক ক্রীড়া সংগঠককে। যিনি শুধু স্বপ্ন দেখেই থেমে থাকেন না, স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথটাও তৈরি করে দেন।
ক্রিকেটে ডেভলপমেন্ট কমিটির নতুন কাজের ধারণাটাও কোকোর। বয়স ভিত্তিক ক্রিকেট চালু করার মধ্য দিয়েই তো বেরিয়ে এসেছে এ সময়ের সেরা তিন প্রতিভা সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল আর মুশফিকুর রহিম। এই তিনজনই এখন বাংলাদেশ জাতীয় দলের নিউক্লিয়াস।
আমার মনে পড়ছে ২০০৫ সালের একটি ঘটনা। লর্ডসে তখন অভিষেকের অপেক্ষায় মুশফিকুর রহিম। তখন তার বয়স মাত্র ১৬। সদ্য কৌশোর পেরোনো একজনকে লর্ডসের মতো বড় আঙ্গিনায় খেলানো নিয়ে তখন অনেক বিতর্ক হচ্ছিল। নানা জন নানা কথা বলছিলেন। প্রশ্ন উঠেছিল-এতো অল্প বয়সী একজনকে লডর্সে কি অভিষেক করানো উচিত? সে সময়টাতে আরাফাত রহমান কোকোর ছিল ইতিবাচক ভুমিকা। তিনি পাশে ছিলেন মুশফিকের। পরে মুশফিক সেই আস্থার প্রতিদানও দিয়েছে।
ঘরোয়া ক্রিকেটের উন্নয়নেও আছে কোকোর বড় অবদান। মনে আছে আমার এই কাছের বন্ধুটি ওল্ড ডিওএইচএসের মাঠে খেলা হলেই চলে আসতো। হাতে থাকতো ব্যাট। ক্রিকেটার, কর্মকর্তাদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার পাশাপাশি খেলতেনও তিনি। যেমনটা বলছিলাম আসলে বলার চেয়ে করে দেখাতেই বেশি পছন্দ করতেন তিনি।
রাজনৈতিক পালাবদলের কারনে শেষ পর্যন্ত অবশ্য ক্রিকেট বোর্ডে কোকোর থাকা হয়নি। থাকতে পারেন নি দেশেও। তবে থাইল্যান্ড আর মালয়েশিয়াতেও থেকে খোঁজ রাখতেন ক্রিকেটের। বাংলাদেশের ম্যাচগুলোর আপডেট রাখতেন তিনি। কোকো দেশের ক্রিকেট নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। মাথায় থাকতো পরিকল্পনা- কী করে এগিয়ে নেওয়া যায় টাইগারদের।
অথচ সেই মানুষটিই বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যেদিন বিশ্বকাপ মিশনে গেল, সেদিনই চলে গেলেন না ফেরার দেশে। আমার বন্ধু, বাংলাদেশ ক্রিকেটের সফল এক সংগঠক আরাফাত রহমান কোকো আর নেই! এই সত্যটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। বেদনায় কাতর হয়ে লিখতে বসেছি!
কোকোর এমন অকাল আর আকস্মিক মৃত্যু আমাকে স্তব্ধ করে দিল। আমাদের কাঁদিয়ে মাত্র ৪৫-এ চলে গেলেন তিনি।
জীবন ছোট তাই বলে এতোটাই ছোট?
Discussion about this post