(দৈনিক কালের কন্ঠ পত্রিকায় ”হায় আবাহনী” শিরোনামের একটি লেখা ছাপা হয়েছে ৫ এপ্রিল। যেটি লিখেছেন বিখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিক, তুমুল জনপ্রিয় লেখক মোস্তফা মামুন। তার সেই লেখাটি ক্রিকবিডি২৪.কম-এর পাঠকদের জন্য ব্লগে তুলে রাখা হল।)
…………………
হায় আবাহনী
আজ সন্ধ্যায় আবাহনী ক্লাবে বিজয় উত্সব হবে খুব সম্ভবত। সেই উত্সবে যতই জাঁকজমক থাকুক তার রংটা হবে কালো। আরেকটি রং থাকলেও থাকতে পারে—লাল, তবে সেটা উত্সবের লাল নয়, লজ্জার লাল।
যেনতেনভাবে জেতার চেষ্টা আর ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহারে এই আবাহনী আসলে চরিত্র হারিয়ে দুশ্চরিত্র। তাই দৃশ্যত যেটা শিরোপা বা সাফল্য উত্সব, সেটা আসলে একরকম শেষকৃত্য। সেখানে যত রংই থাকুক আসল রং পতনের, শোকের; কালো। আর সত্যিকারের সমর্থকদের চেহারার রং! লজ্জায় লাল।
সেদিন আবাহনীর পুরনো আমলের এক কর্মকর্তা কথায় কথায় একটা গল্প বলছিলেন। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়, তিনি যখন ম্যানেজার তখন জাতীয় দলের একজন পেসার ছিলেন আবাহনী দলে। একটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ গড়িয়েছিল শেষ ওভারে। যেকোনো দিকে যেতে পারে ম্যাচ, এ অবস্থায় বোলারটি বল না করে রানের জন্য বেরিয়ে যাওয়া নন স্ট্রাইকারের উইকেট ভেঙে দিলেন। তাতে ম্যাচটি আবাহনী জিতল কিন্তু পরের ম্যাচে সেই বোলারটি দল থেকে বাদ! কারণ, তাঁর এই অখেলোয়াড়োচিত আচরণকে তখনকার কর্মকর্তারা আবাহনীর গৌরবের সঙ্গে বেমানান মনে করেছিলেন। এটাকে এখন সত্য যুগের গল্প বলে মনে হয় এবং আবাহনীও ‘রাজা রামচন্দ্র’ ছিল না যে পদস্খলন তাকে স্পর্শ করেনি। প্রতিযোগিতামূলক লিগ বা টুর্নামেন্ট জিততে গিয়ে আর দশটি দলের মতো অনৈতিক চেষ্টা আবাহনীও করেছে হয়তো, কিন্তু সেগুলো বিচ্ছিন্ন চেষ্টা। আর আবাহনী যতটা করেছে তার চেয়ে বেশি এর শিকার হয়েছে। কিন্তু গত কয়েক বছরের চিত্র ভিন্ন। ক্ষমতার অহংকার আর নির্লজ্জ চর্চা আবাহনীকে এত নিচে নামিয়েছে যে আবাহনী ক্রীড়াঙ্গনের ভিলেন। এই প্রজন্মের সাংবাদিকরা দেখি, আবাহনীর নাম শুনলেই হাসে। কারণ তারা দেখছে, আবাহনী মানে সেই দল যারা আম্পায়াকে ম্যানেজ করে, সুবিধামতো বিকেএসপি-ফতুল্লায় ম্যাচ ফেলে যাতে ওখানে খুব বেশি সাংবাদিক যেতে না পারে, বিপক্ষকে জোর করে বৃষ্টিতে খেলতে নামায় এবং যখন-তখন সন্দেহজনক ম্যাচ খেলে। এই প্রজন্ম এই আবাহনীকে দেখেছে বলে ওদের বিষয়টা হাসাহাসিতেই শেষ হয়, কিন্তু আমরা যারা আকাশি-নীলের ছায়ায় বড় হয়েছি, এই হাসিটা আমাদের তীরের চেয়েও বেশি বিদ্ধ করে। হ্যাঁ, এখন আমাদের বদলে যাওয়া অদ্ভুতুড়ে ক্রীড়াবোধে আবাহনী-মোহামেডান হারিয়ে গেছে, কিন্তু কয়েকটা দশক এই দেশের কিশোর-তরুণদের বিকাশই হয়েছে আবাহনী-মোহামেডানের সঙ্গে চলে। মনে আছে, আবাহনীর একটা জয় পরের কয়েকটা দিন মন এমন আনন্দে ভিজিয়ে রাখত যে স্কুলের বিরক্তিকর ক্লাসকেও আনন্দময় মনে হতো। বাবা-মায়ের বকাঝকার সময়ও মন বলত, আরে দুঃখের কী আছে! আবাহনী তো জিতেছে। চুন্নু তো গোল করেছে। দিন চলে গেছে কিন্তু অ্যালবামে সোনালি আবেগটুকু আজও আনন্দধারা হয়ে নিরন্তর বয়ে চলে। আমাদের সেই আবাহনীকে কৌতুকের বিষয় বানিয়ে দিয়েছে কিছু মানুষ। আবাহনীর কর্মকর্তা নামধারী এই মানুষগুলোর ওপর রাগ হয় স্বাভাবিক। সঙ্গে করুণাও হয় এই ভেবে যে এঁরা আসলে আবাহনীর মর্মার্থ বুঝতে মর্মান্তিকভাবে ব্যর্থ।
এই যুগে এটা জানতে কারো বাকি নেই যে আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতার নাম শেখ কামাল। বঙ্গবন্ধুর অল্পবয়সী কিন্তু দূরদর্শী এই পুত্রটি নতুন দেশ তৈরির পর চিন্তা করে দেখলেন যে তরুণ প্রজন্মের সত্যিকারের বিকাশের জন্য দরকার তাদের ক্রীড়ামুখী করা। দিতে হবে বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলানো আধুনিক খেলার পাঠ। তৈরি হলো আবাহনী। তখনকার প্রধান খেলা ফুটবলে আবাহনী নিয়ে এলো নতুনত্ব, দৌড়-শট বাদ দিয়ে যে ছোট ছোট পাসে ফুটবলটা খেলা যায় সেটা দেখে নতুন প্রজন্ম চমকিত। এবং আবাহনীর স্বপ্নযাত্রার সঙ্গী। তরুণ প্রজন্মকে আধুনিকতার দিশা দেওয়াটার কথা সবাই বলেন, কিন্তু গভীরভাবে দেখলে আমাদের বৃহত্তর জাতীয় জীবনে এর চেয়েও বড় গুরুত্ব আছে আবাহনীর। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নির্মমভাবে নিহত হলেন শেখ কামালও। বৈরী রাজনৈতিক পরিবেশে আওয়ামী লীগের নাম নেওয়াই তখন কঠিন। সুবিধাবাদী নেতারা পালালেন বা পাল্টালেন, সমর্থকরাও চাপে চুপ। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সাম্য আর অসাম্প্রদায়িকদার পক্ষের মানুষগুলোর কথা বলার আর সেই অর্থে কোনো প্ল্যাটফর্মই নেই। আবাহনীও সমান্তরালে চরম বিপাকে। টিকে থাকবে কি না, সেটা নিয়েই প্রশ্ন। কিছু অসীম সাহসী মানুষের পৃষ্ঠপোষকতা আর আন্তরিকতায় রক্ষা হলো। আর তখনই ঘটল ঘটনাটা। আবাহনী খেলার সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে গেল বৃহত্তর সামাজিক সমীকরণে। আওয়ামী লীগ বা তাদের সমর্থকরা অন্য কোনোখানে নিজেদের ব্যক্ত করতে পারেন না কিন্তু মাঠে আবাহনীকে তো সমর্থন করতে পারেন। আর তাই দলবেঁধে তাঁরা এসে দাঁড়ালেন আবাহনীর পেছনে। তৈরি হলো আবাহনীর সমর্থনের জোয়ার। শেখ কামাল জীবিত থাকা অবস্থায় যে আবাহনী এত ভালো খেলেও প্রত্যাশিত সমর্থন পাচ্ছিল না, এখন তাদের পেছনে জোয়ারের মতো মানুষ। এই মানুষগুলোর মধ্যে খেলার বা ফুটবলের মানুষ ছিল, কিন্তু আশ্রয়স্থল ভেবে জড়ো হয়েছিল বিপন্ন আওয়ামী লীগ সমর্থকরাও। পরের এক-দেড় দশক তাই আবাহনী আওয়ামী লীগ, বাঙালি জাতীয়তাবাদেরও প্রতীক। কাতালান আর বার্সেলোনার যে গল্প নিয়ে আমরা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি, এখন আমাদের আবাহনীরও সেই গল্প আছে। আবাহনী তাই শুধুই একটা খেলার দল নয়, এর চেয়ে অনেক বড়। এটা যদি হয় আবাহনীর দ্বিতীয় সামাজিক গুরুত্ব, তবে তৃতীয় আরো একটা আছে। বিরোধী শক্তির প্রতীক বলে আবাহনীকে সইতে হয়েছে বিস্তর বঞ্চনা। পয়েন্ট কেটে নেওয়া হয়েছে ঠুনকো ঘটনায়, জেল খাটানো হয়েছে খেলোয়াড়দের, জাতীয় দলের প্রাপ্য অধিনায়কত্ব হারিয়েছেন আবাহনীর ফুটবলার, রেফারির বাঁশি বেজেছে বিপক্ষের সুরে। কত যে অবিচার! কিন্তু সেই অবিচার মাঠের আবাহনীকে দৃঢ় করেছে আর মাঠের বাইরে পেছনে মানুষের স্রোত বেড়েছে আরো। কারণ, আবাহনী অবিচারের শিকার হওয়ার মাধ্যমে হয়ে উঠেছিল বঞ্চিতদের প্রতীক। ফলে সমাজ বা অন্য ক্ষেত্রে যে বা যারা বঞ্চিত হয়েছে তারাই আবাহনীকে ভেবেছে তাদের দল। নিজেদের খুঁজে পেয়েছে আবাহনীর পেছনে দাঁড়িয়ে। মনে করেছে বঞ্চনার জবাব মাঠের আবাহনী যেভাবে দিচ্ছে এভাবে একদিন সে-ও দেবে নিজের ক্ষেত্রে।
তারুণ্যের আধুনিকতার দিশা, দেশে ক্ষীণ হয়ে যাওয়া স্বাধীনতার পক্ষের ধারাকে ধরে রাখা এবং বঞ্চিতদের প্ল্যাটফর্ম হয়ে তাদের জীবনযুদ্ধ জেতানোর প্রেরণা। এই হলো আমাদের আবাহনী। অথচ সেই আবাহনী যারা ছিল বঞ্চিতদের দল তারাই আজ অন্যদের বঞ্চিত করার তালে। ক্ষমতার বিপক্ষে ছিল তার চিরকালের লড়াই অথচ আজ নির্লজ্জ ক্ষমতাভোগী। এই আবাহনীকে চরিত্র হারানো চরিত্রহীন বলব না তো কী বলব!
এই সেদিন শেখ কামালকে নিয়ে একটা স্মারকগ্রন্থের পাতা ওল্টাচ্ছিলাম। তাঁকে নিয়ে কত অপপ্রচার শুনে বড় হয়েছি, কিন্তু ক্রীড়া সাংবাদিকতায় এসে ভুলের পর্দাগুলো সরে যাওয়ার পর অবাক হয়ে দেখেছি এক স্বপ্নবাজ তরুণকে। বন্ধু-বান্ধবদের লেখা সেই কিছু ক্ষেত্রে আবেগের বাড়াবাড়ি থাকলেও এটা স্পষ্ট যে খেলা ছিল তাঁর কাছে দ্বিতীয় জীবন। আর আবাহনী সেই জীবনের অন্য নাম। কৌতূহলবশত একটু পেছন ফিরে গিয়ে দেখছি, আবাহনী তাঁর জীবদ্দশায় চারটি ফুটবল লিগের মধ্যে মাত্র একটি লিগ জিতেছে। ক্রিকেট ও হকিতেও একটি করে। এখনকার মতো ক্ষমতার চর্চা করে সবগুলো লিগই শেখ কামাল আবাহনীর জন্য নিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু তাহলে আর আবাহনী কোটি মানুষের ভালোবাসার আবাহনী হয় না। সামান্য কিছু জিতেও সেই আবাহনী ছিল হূদয়ে আর সব জিতেও এখনকার আবাহনীর জায়গা হচ্ছে ঠাট্টা-বিদ্রূপে।
আজ আবাহনীর সম্ভাব্য আনন্দসন্ধ্যায় তাই শেখ কামালেরও প্রবেশাধিকার নেই। ওপার থেকে তাঁর সুযোগ নেই এপারে আসার, তবু সুযোগ থাকলেও আসতেন না বোধ হয়। ক্লাবের আশপাশে বিষণ্ন ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে আর্তির মতো বলতেন, না, এই আবাহনী আমার নয়।
সত্যি এই আবাহনী শেখ কামালের স্পিরিটের নয়। এই আবাহনী আমাদেরও নয়। এই আবাহনী তাহলে কার?
মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের, যারা ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ হয়ে আবাহনীর মর্মার্থ বুঝতে মর্মান্তিকভাবে ব্যর্থ।
Discussion about this post