দেশে এখন কোনো বিদেশি দল নেই। তাই আন্তর্জাতিক খেলা বা সিরিজ হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কাল প্রিমিয়ার লিগেরও কোনো ম্যাচ ছিল না। কিন্তু সকাল ১১টা থেকেই শেরেবাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়াম সরব। শতশত কিশোর-যুবার অযাচিত উপস্থিতি। হইচই। মুহুর্মুহু স্লোগান। শেরেবাংলার মূল গেটের ভেতর থেকে বিসিবি ভবন পর্যন্ত মাঝের বিশাল খালি জায়গায় খণ্ড খণ্ড মিছিল। বিসিবি ভবনের দেয়ালে বড় সাইজের ব্যানার। সাদার ভেতর কালো হরফে লেখা নানা ব্যানার-ফেস্টুন।
এটুকু শুনে নিশ্চয়ই ভাবছেন ভেতরে বুঝি কোনো ক্রিকেট উত্সব ছিল। নাহ, মোটেই তা নয়। কাল হোম অব ক্রিকেটে কোনো ক্রিকেট উত্সবও ছিল না। ওই ব্যানার-ফেস্টুনেও কোনো ক্রিকেটীয় স্লোগান বা বক্তব্য ছিল না। আর শতশত কিশোর-যুবাও দেশের ক্রিকেট উন্নয়ন ও মঙ্গলে মিছিল করেনি। পুরো আয়োজনটা ছিল লুত্ফর রহমান বাদলের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার। মিছিলে যত স্লোগান দেওয়া হয়েছে তার পুরো অংশজুড়েই ছিল লিজেন্ড অব রূপগঞ্জের স্বত্বাধিকারীর চরিত্র হনন।
ক্লাব ক্রিকেটে আম্পায়ারিং ও অন্যান্য ইস্যুতে বক্তব্য-পাল্টা বক্তব্য নতুন নয়। তবে চরিত্র হনন পর্বটা নতুন। লুত্ফর রহমান বাদল মিডিয়ার কাছে বোর্ডপ্রধান ও দুই পরিচালকের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে যে কাদা ছোড়াছুড়ি শুরু করেন, কাল তার বিরুদ্ধে শোডাউন, ব্যানার লাগানো, অশ্লীল স্লোগানে ভরা মিছিল এবং সংবাদ সম্মেলনে তার পাল্টা জবাব দেওয়া হল। যার পরতে পরতে ছিল কাদা ছোড়াছুড়ি।
যা দেখে ক্রিকেটপ্রেমিরাও বলতে বাধ্য হচ্ছেন-‘নাহ, বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে গেল।’
দেশের ক্রিকেটের মূল ভেন্যু শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের মূল গেটের ভেতরে ঠিক বিসিবি অফিসের বাইরে কোনো ক্লাব কর্তার বিরুদ্ধে এমন প্রমাণ সাইজের ব্যানার লাগানো, বহিরাগতদের অশ্লীল স্লোগানের মিছিল। ভাবা যায়!
অতি সম্প্রতি আম্পায়ারিংয়ের সমালোচনা করার পাশাপাশি তার দল লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জ অন্যায় ও গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার-মিডিয়ার কাছে এমন অভিযোগ করতে গিয়ে এক পর্যায়ে বিসিবিপ্রধান নাজমুল হাসান পাপন, বোর্ড পরিচালক আইএইচ মল্লিক এবং জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও বোর্ড পরিচালক খালেদ মাহমুদ সুজনের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন লুত্ফর রহমান বাদল। যা ছিল ব্যক্তিগত আক্রমণের শামিল। সৌজন্যতা নম্রতা-ভব্যতা ও শিষ্টাচার বহির্ভূত। রূপগঞ্জ অধিপতির অমন বক্তব্যর জবাবে বিসিবি কিছুদিন আগে একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতিও প্রদান করে। সেখানে বাদলের বক্তব্যকে নম্রতা-ভব্যতা ও শিষ্টাচারের বাইরে বলে অভিহিত করে তীব্র নিন্দা প্রকাশ করা হয়। ভাবা হচ্ছিল কাল সংবাদ সম্মেলনে প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্লাব অ্যাসোসিয়েশনও ওই বক্তব্যর আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ করবে।
কিন্তু আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদের নামে বাদলের চরিত্র হনন! তার বিরুদ্ধে রাজ্যের বিষোদ্গার হবে-তা ভাবেননি কেউ। অথচ সেটাই হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, সংবাদ সম্মেলনে আবাহনীর পরিচালক কাজী নাবিল আহমেদ যে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেছেন, তার মূল অংশজুড়েই ছিল তীব্র আক্রমনাত্মক ও অশোভন ভাষায় বাদলের বক্তব্যের প্রতিবাদ।
সংবাদ সম্মেলনের ভূমিকা দিতে গিয়ে কাজী নাবিল বলেন-‘ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্লাব অ্যাসোসিয়েশন, ক্রিকেটার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, আম্পায়ার ও স্কোরার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এবং জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়কবৃন্দ মিলে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেছেন। গত ৪ ডিসেম্বর প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবের কর্ণধার লুত্ফর রহমান বাদল বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, উদ্ভট ও নৈতিকতা বিবর্জিত অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং ঘৃণ্য সমালোচনামূলক বক্তব্য রেখেছেন। তার বক্তব্যের আনুষ্ঠানিক তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করার জন্য আজকের এ সংবাদ সম্মেলন।’ পাশাপাশি ওই বক্তব্যে বাদল এবং তার দল লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জকে ক্রীড়াঙ্গন থেকে বহিষ্কারের দাবিও করা হয়। প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও কামনা করা হয়েছে।
বিসিবি অফিসের দেয়ালে ব্যানার টানানো এবং বাইরের লোকজন এনে শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের ভেতরে মিছিল কেন?
বোর্ড পরিচালক নাজমুল করিম টিংকুর জবাব, ‘এটা বিক্ষুব্ধ সমর্থকের কাজ। আমরা এর সঙ্গে যুক্ত নই।’ তাই যদি না হবে, তাহলে সেই বিক্ষুব্ধ সমর্থকরা বোর্ড অফিসে ব্যানার টানাল কীভাবে? শতশত কিশোর-যুবা ও তরুণ শেরেবাংলার নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে ভেতরেই বা ঢুকল কী করে? মূল গেটের নিরাপত্তা কর্মীরা তাদের ঢুকতে দিল? এসব প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি। কোয়াবের পক্ষে সভাপতি নাঈমুর রহমান দুর্জয়, সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত পালের কেউ নেই কেন?
এসব প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন খালেদ মাহমুদ সুজন। তার ব্যাখ্যা-‘ক্ষুব্ধ সমর্থক যদি তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করে তবে আমাদের কিছু করার নেই। দেয়ালে লাগানো আছে এটা আমরা দেখেছি। এগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে আমাদের মধ্যে।’ আর কোয়াবের বিবৃতি সম্পর্কে তার ব্যাখ্যা, ‘কোয়াব সভাপতি নাঈমুর রহমান দুর্জয় পুরো বিষয়টা জানেন। তার মত নিয়েই করা হয়েছে। তিনি বিদেশের পথে বিমানবন্দরে। তাই আসতে পারেননি।’
পুরো বিষয়টি কাদা ছোড়াছুড়ি। শালীনতা বিবর্জিত। এ সম্পর্কে খালেদ মাহমুদ আবেগতাড়িত হয়ে যা বলেন, তার ভাবার্থ দাঁড়ায়-বাদল ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন। আমরাও পাল্টা জবাব দিলাম-‘আমরা তাকে (বাদলকে) ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করিনি। কিন্তু তিনি আমাকে, বোর্ডপ্রধান এবং আরেকজন পরিচালককে আক্রমণ করে বক্তব্য দিয়েছেন। ৩০ বছর ক্রিকেটের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আমি। জাতীয় দলের অধিনায়ক, ম্যানেজার ও সহকারী কোচ ছিলাম। এখন বোর্ড পরিচালক। তারপরও আমাকে বোর্ড পিয়নের সঙ্গে তুলনা করা হয়ছে। তাহলে কী বলব বলুন?’
বক্তব্য-পাল্টা বক্তব্যর পালায় কিছু রাজনৈতিক ভাষাও উচ্চারিত হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি-তা এসেছে খালেদ মাহমুদ সুজনের মতো দেশবরেণ্য ক্রিকেট ব্যক্তিত্বের মুখে। ৬ ডিসেম্বর রূপগঞ্জ যুগ্ম সম্পাদক তারিকুল ইসলাম টিটুকে নাজেহাল করা হয়। বিকেএসপিতে তাকে গাড়ি থেকে টেনেহেঁচড়ে বের করার প্রচেষ্টার নিন্দা ও তদন্তের কথা না বলে খালেদ মাহমুদ অবলীলায় বলে দিলেন-‘বিসিবির এমন কোনো লোক নেই যারা গিয়ে এমন কাণ্ড ঘটাবে। এটা মনে হয় ষড়যন্ত্রেরই ব্যাপার। মিরপুরে খেলা হলে আমরা দেখি অনেক লুঙ্গি পরা তাদের দর্শকও আসেন। কারা বিকেএসপি গিয়েছে সেটা আমরা বলতে পারব না। ম্যাচ রেফারি আছেন। একটা রিপোর্ট তো অবশ্যই দেবে। তার ওপর ভিত্তি করে তদন্ত করা হলে হবে। ক্লাব লেভেলে এগুলো নতুন কোনো ঘটনা নয়। এটা তারাই (রূপগঞ্জ) ঘটিয়ে এখন বিসিবির ওপর দোষ চাপাচ্ছে!’
তবে সবচেয়ে অবাক করা তথ্য হল-বিকেএসপিতে ৬ ডিসেম্বর তারিকুল ইসলাম টিটুকে গাড়ি থেকে নামিয়ে এনে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা যে অপরিচিত যুবকরা করেছিল; তাদের কয়েকজনকে গতকাল দুপুরে বিসিবির বারান্দায় বাদলের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে দেখা গেছে। দুজন প্রভাবশালী বোর্ড পরিচালকের পাশে তাদের বেশ পরিচিতের ভঙ্গিতে হাঁটতেও দেখা গেছে!
#লেখাটি ৯ ডিসেম্বর দৈনিক সকালের খবরে ছাপা হয়েছে।
Discussion about this post