সোমবার ভোরে মারাকানায় ফিফা কনফেডারেশন কাপের ফাইনালে বিশ্ব আর ইউরো চ্যাম্পিয়ন স্পেনকে ৩-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে টুর্নামেন্টে হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন হল ব্রাজিল। সংশয় এবং সন্দেহের অবসান ঘটিয়ে রেকর্ড পাচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা জানিয়ে দিল ১৯৫০ এর মারাকানা ‘ট্রাজেডি’ মুছে ঘরের মাঠে ২০১৪ বিশ্বকাপ ট্রফিটা ষষ্ঠবারের মতো ফের তাদের চাই। বিশ্বকাপের মতো কনফেডারেশন কাপও সর্বাধিক চারবার জিতল ব্রাজিল।
ফ্রেডের দুটি এবং নেইমারের এক গোলেই শেষ হয়ে গেছে স্পেনের প্রথমবারের মতো ফিফা কনফেডারেশন কাপ জেতার স্বপ্ন। আসলে ব্রাজিল যেন কনফেডারেশন কাপে তাদের সেরা খেলাটা জমিয়ে রেখেছিল ফাইনালের জন্যই। আর সেটা এই সময়ের অবিসংবাদিত সেরা দল স্পেনের বিপক্ষেই। ফিফা র্যাংকিংয়ে নিজেদের সর্বকালের সর্বনিম্ন অবস্থান ২২ নম্বরে পৌছে যাওয়া ব্রাজিল যেন জ্যাত্যাভিমানেই ভুগছিল। যে দেশের ফুটবল নিয়ে বলা হয়, ব্রাজিলে ফুটবলার তৈরি হয় না, জন্মায়- সেই ফুটবল ঐতিহ্যের এমন পতন যে সত্যিই মেনে নিতে পারছিল না ব্রাজিল সমর্থকরা। কনফেডারেশন কাপ তাই পরিনত হয়েছিল ব্রাজিলের পরীক্ষায়। সেই পরীক্ষায় প্রথম হয়ে ব্রাজিল বলে দিল, ‘ র্যাংকিং আসলে ছেদো কথা, মাঠের পারফরম্যান্সটাই আসল।’ এই সেদিন ২০০৮ সালে ইউরো চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর থেকে যে স্পেনের এত রমরমা, তারাই কিনা ব্রাজিলকে এক হাত নেবে ব্রাজিলের মাঠে? এটা কী মেনে নিতে পারেন নেইমার-ফ্রেডরা? অতএব ফুটবল বিশ্বকে বুঝিয়ে দিতে হবে, ব্রাজিল আছে ব্রাজিলেই। সেটাই প্রমাণ করে দিল পেলে, জিকোর দেশ।
স্পেনের কপাল মন্দ, ব্রাজিল তো দুর্দান্ত খেলেছেই, পাশাপাশি টুর্নামেন্টে নিজেদের সবচেয়ে বাজে দিনটাও ভিসেন্ত দেল বস্কের দল কাটিয়েছে ফাইনালে। নইলে ব্রাজিল এক গোলে এগিয়ে যাওয়ার পর ফাকা পোস্টে পেদ্রো রডরিগুয়েজের শট গোলে ঢোকার ঠিক আগে কোথা থেকে উড়ে এসে বাচাবেন ডেভিড লুইস। নইলে তখনই তো ম্যাচ ১-১ হয়ে যায়। এখানেই শেষ নয়, দ্বিতীয়ার্ধে রামোসের পেনাল্টি মিস গোটা দলকে আরও বিহবল করে তোলে। কফিনে শেষ পেরেক, ৬৮ মিনিটে পিকের লাল কার্ড। শেষ ডিফেন্ডার হিসেবে নেইমারকে ল্যাং মেরে ফেলে দিলে ডাচ রেফারির লাল কার্ড দেখানো ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। তখন স্পেন তিন গোলে পিছিয়ে। ম্যাচে ফেরার সব আশা মূলত তখনই শেষ হয়ে যায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের।
ম্যাচে স্পেন কি গেমপ্ল্যান নিয়ে নেমেছিল কে জানে? কিন্তু সেটাই মস্ত ধাক্কা খায় খেলা শুরুর মাত্র ২ মিনিটেই ব্রাজিলের গোলে। টুর্নামেন্টের নিজেদের প্রথম ম্যাচে জাপানের বিপক্ষে খেলা শুরুর ৩ মিনিটে গোল করেছিল ব্রাজিল। স্পেন গোল খায় তারও আগে। ডানপ্রান্ত থেকে ক্রস করেছিলেন হাল্ক। সেটা গোলমুখে নেইমারের গায়ে লেগে পড়ে ফ্রেডের সামনে। সুযোগসন্ধানী এ স্ট্রাইকার পড়ে গিয়েও যে শট নেন তার আশ্রয় নেয় জালে। এ গোল ব্রাজিলকে আরও তাতিয়ে দেয়। পরের ১২ মিনিটের মধ্যে আরও দুই গোল পেতে পারত স্বাগতিকরা। ৮ মিনিটে ফ্রেড ডি বক্সের মাথায় অস্কারের জন্য যে বল সাজিয়ে দিয়েছিলেন, তা থেকে চেলসি স্ট্রাইকারের নেওয়া শট অল্পের জন্য পোস্ট ঘেষে বাইরে চলে যায়। ১৪ মিনিটে মাঝমাঠের জেনারেল পাওলিনহোর বুদ্ধিদীপ্ত শট কোনোমতে ঠেকান ইকার ক্যাসিয়াস। ব্রাজিলের এমন ঝড়ো আক্রমনের মুখে এলোমেলো স্পেন ডিফেন্স ডাচ রেফারির সৌজন্যে দু’বার বড় বিপদের হাত থেকে বেচে যায়। নেইমার এবং অস্কারকে শেষ ডিফেন্ডার হিসেবে ফাউল করেছিলেন যথাক্রমে আলভারো আরবেলোয়া ও রামোস। রেফারি লাল কার্ড দেখালে অত্যুক্তি হত না। কিন্তু দুই স্প্যানিশ ডিফেন্ডারকে হলুদ কার্ড দেখিয়েই ছেড়ে দেন রেফারি।
ব্রাজিলের এমন চাপের মুখে স্পেন যে মাঝেমধ্যে পাল্টা আক্রমন চালায়নি তা নয়। কিন্তু পুরো টুর্নামেন্টে জাভি ফ্লপ থাকায় ইনিয়েস্তার একার পক্ষে দলকে টানা সম্ভব হয়নি। সামনে স্ট্রাইকার ফার্নান্দো তোরেস ফের ব্যর্থ। কেবল পেদ্রো একটি প্রান্ত থেকে বল টেনেছেন। শেষ দিকে তোরেসের বদলে ডেভিড ভিয়া নেমে খানদুয়েক চেস্টা নিয়েছিলেন, কিন্তু বারের নীচে অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে তা রুখে দেন ব্রাজিল গোলকিপার জুলিও সিজার। তারপরও ৪১ মিনিটে পেদ্রো ফাকা পোস্টে যে শট নিয়েছিলেন তা অলৌকিকভাবে লুইস রুখে না দিলে কি হতো বলা মুশকিল। বিপরীতে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো বিরতির ঠিক আগে দ্বিতীয় গোল খেয়ে বসে স্পেন। অস্কারের সঙ্গে বল দেওয়া – নেওয়া করে ডি বক্সের ভেতর থেকে নেইমার বা পায়ে গোলার মতো যে শট নেন, তা দেখে ঈর্ষা হতে পারে এমনকি লিওনেল মেসিরও। সে শট ঠেকানোর কোনো সাধ্য ছিল না ক্যাসিয়াসের। প্রথমার্ধে ব্রাজিল এগিয়েছিল দুই গোলেই।
দ্বিতীয়ার্ধে স্পেন হয়তো নেমেছিল শেষ একটা মরনকামড় দেওয়ার জন্য। কিন্তু আবারও উল্টো ধাক্কা। এবারও ফ্রেড। পাওলিনহো স্পেন ডি বক্সে যে বল ফেলেন, সেটা নেইমার ছেড়ে দিলে পেয়ে যান ফ্রেড। ডান পায়ের কোনাকুনি মাটি কামড়ানো শটে ব্রাজিল স্ট্রাইকার ফের ক্যাসিয়াসকে পরাস্ত করেন। টুর্নামেন্টে পাচ গোল করে স্পেনের তোরেসের সঙ্গে যৌথভাবে সর্বাধিক গোলদাতা হয়েছেন ফ্রেড। যার প্রধান গুন, আক্রমনের সময় ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় থাকা। তিন গোলে পিছিয়ে পড়া স্পেনের পক্ষে এরপর আর কিছুই যায়নি। মার্সেলো ডি বক্সে বদলি খেলোয়াড় জেসাস নাভাসকে ফাউল করলে স্পেন যে পেনাল্টি পায়, সেটাও যদি গোল হত, বস্কের দল হয়তো ফিরে আসার জন্য আরেকবার ঝাপাতো। কিন্তু রামোস পেনাল্টি বাইরেই মেরেছেন। অতঃপর পিকের লালকার্ড। তারপরও অবশ্য লড়াই চালিয়ে গেছে স্পেন। কিন্তু দেহের ভাষা ক্রমশই নেতিয়ে পড়েছে স্প্যানিশদের। সান্তনাসূচক গোল পেতে পারতেন ভিয়া। কিন্তু তার শটও ঝাপিয়ে ঠেকান সিজার। তখন অবশ্য ম্যাচ শেষ হতে আর সামান্য বাকি। তার খানিক পরই রেফারি শেষ বাজি বাজাতেই গ্যালারিতে ওঠে সাম্বার ঢেউ আর মাঠে শুরু নেইমার-ফ্রেডদের উল্লাস। তবে তাতে ছিল সংযম। কারন সামনে যে বিশ্বকাপ!
Discussion about this post