আজ থেকে ঠিক ২৫ বছর আগে, ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর, ইতিহাসের পাতায় নতুন এক অধ্যায় সূচনা করেছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। স্থান: ঢাকার তৎকালীন বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। দিনটি ছিল এক উৎসবমুখর শুক্রবার, আর সেই সকালটি যেন বাঙালির ক্রিকেটযাত্রার সূর্যোদয়।
জাতীয় পতাকার রঙে সেজে উঠেছিল গ্যালারি, বাতাসে উড়েছিল তিন হাজার বেলুন, আর আকাশ থেকে প্যারাট্রুপারদের অবতরণে ফুটে উঠেছিল টেস্ট পরিবারের নবীন সদস্যের আগমন। একজনের হাতে ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের লোগোযুক্ত পতাকা, আর বাকি দশজনের হাতে টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর পতাকা। সেই প্রতীকী মুহূর্তেই বিশ্ব ক্রিকেটে যুক্ত হয় লাল-সবুজের নাম-বাংলাদেশ।
স্মারক স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে হয় টস, আর ইতিহাস সৃষ্টি হয় যখন প্রথমবারের মতো দুই অধিনায়ক-বাংলাদেশের নাঈমুর রহমান দুর্জয় ও ভারতের সৌরভ গাঙ্গুলী—বাংলায় কথা বলেন টসের সময়। সকাল সাড়ে ৯টায় ভারতের জাভাগাল শ্রীনাথ দৌড় শুরু করেন, এবং বাংলাদেশের ওপেনার শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ সেই ঐতিহাসিক প্রথম বলের মুখোমুখি হন।
অভিষেক ম্যাচে বাংলাদেশ দেখিয়েছিল আত্মবিশ্বাসের ঝলক। প্রথম ইনিংসে তারা করে ৪০০ রান-এক নবীন দলের জন্য তা ছিল এক দৃষ্টান্ত। তবে দ্বিতীয় ইনিংসে ধস নামে, ৯১ রানে গুটিয়ে যায় দলটি। ভারতের সামনে সহজ টার্গেট ছিল মাত্র ৬৩, যা তারা ৯ উইকেট হাতে রেখেই পূরণ করে। ফলাফলটা ছিল পরাজয়, কিন্তু দিনটি ছিল জয়োৎসবের-কারণ সেদিন বাংলাদেশ জন্ম দিয়েছিল নতুন এক যুগের।
এরপর কেটে গেছে ২৫ বছর। এই এক চতুর্থাংশ শতকের যাত্রা ছিল উত্থান–পতনের গল্পে ভরা। প্রথম টেস্ট জয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয় পুরো পাঁচ বছর। ২০০৫ সালে চট্টগ্রামের এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে জিম্বাবুয়েকে ২২৬ রানে হারিয়ে টাইগাররা তুলে নেয় ইতিহাসের প্রথম জয়। তার আগে পর্যন্ত ৩৪ ম্যাচে ৩১ হার ও ৩ ড্র-সংগ্রামের এক দীর্ঘ অধ্যায়।
দ্বিতীয় টেস্ট জয় আসে আরও চার বছর পর, এবার বিদেশের মাটিতে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বে ২-০ ব্যবধানে সিরিজ জয়। সেটিই ছিল বাংলাদেশ টেস্ট দলের প্রথম বিদেশ জয়, যা নতুন আত্মবিশ্বাস যোগায় গোটা জাতিকে।
তবে পরিসংখ্যান এখনো বলছে, লাল বলের ক্রিকেটে বাংলাদেশের লড়াই কঠিন। ২৫ বছরে ১৫৪ ম্যাচ খেলে জয় এসেছে মাত্র ২৩টিতে, হার ১১২, ড্র ১৯। কিন্তু এই অঙ্কের পেছনে আছে অগণিত আবেগ, স্বপ্ন আর স্মৃতির গল্প।
স্মরণীয় জয়গুলোর মধ্যে অন্যতম ২০১৭ সালের শততম টেস্ট-কলম্বোর পি সারা ওভালে শ্রীলঙ্কাকে ৪ উইকেটে হারানো। ২০২২ সালে নিউজিল্যান্ডের মাউন্ট মঙ্গানুইতে ৮ উইকেটের জয় ছিল টেস্ট ইতিহাসে অবিশ্বাস্য এক অধ্যায়। আর সর্বশেষ আলোচিত জয়—২০২৪ সালে পাকিস্তানের মাটিতে ২-০ ব্যবধানে সিরিজ জয়, যা টেস্ট ইতিহাসে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা কীর্তি।
সেই সিরিজেই দেখা গেছে এক নতুন বাংলাদেশের রূপ-২৫ রানে ৫ উইকেট হারানোর পর লিটন দাস ও মেহেদী মিরাজের বীরোচিত জুটি ভক্তদের হৃদয়ে গেঁথে যায় চিরদিনের মতো।
আজ যখন ফিরে দেখা হয় সেই ২০০০ সালের সকাল, তখন মনে হয়-এই তো সেদিন! যখন প্যারাট্রুপারের হাতে উড়ে এসেছিল লাল-সবুজ পতাকা, গ্যালারিতে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল “বাংলাদেশ” ধ্বনি। সেই ধ্বনির প্রতিধ্বনি এখনো ভেসে আসে প্রতিটি টেস্ট মাঠে, প্রতিটি নতুন লড়াইয়ের আগে।










Discussion about this post