‘এটা ভুল সিদ্ধান্ত’-মন্তব্যটা এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের প্রধান নির্বাহী সৈয়দ আশরাফুল হকের।
‘শক্তিমানের সামনে নতজানু হয়ে আত্মসমর্পণ করার চেয়ে দায়িত্ববান হওয়া এবং জীবনে আরও অনেক কিছু করার সুযোগ আছে’-শিক্ষাটা বিসিবির সাবেক সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরীর।
‘যেহেতু বিষয়টা জটিল এবং এই সংক্রান্ত অনেক প্রশ্নের উত্তরই আমাদের জানা দরকার, সেজন্য আমাদের যে মনোভাবই থাক না কেন, সেটা এখন প্রকাশ করতে চাচ্ছি না। এ ব্যাপারে অন্য দেশগুলোর অবস্থান জেনে আমরা আমাদের মতামত দেব’-বক্তা বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন।
প্রথম দু’জনের বক্তব্য স্পষ্ট। দৃঢ়। তৃতীয়জনের কথায় পরিষ্কার সিদ্ধান্ত নেই।
উপরের এই তিনজনই আইসিসির নতুন তিন ‘মোড়ল’-এর ক্ষমতা দখলের প্রসঙ্গে এই মন্তব্য করেছেন। পজিশন পেপারস নামে ভারত-অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড আইসিসির পূর্ণ ক্ষমতা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেওয়ার যে অবিশ্বাস্য ষড়যন্ত্র কষছে-তাতে সরাসরি এবং সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। এই কুটিল প্রস্তাবের মধ্যে দ্বিস্তর টেস্ট বিষয়ক একটা এজেন্ডা রয়েছে; যেটা পাস হলে বাংলাদেশ টেস্ট মর্যাদা পাওয়া দেশ হয়ে থাকলেও টেস্ট খেলতে পারবে না! র্যাঙ্কিংয়ে নিচের দিকে থাকায় বাংলাদেশকে রেলিগেটেড হয়ে যেতে হতো। কিন্তু কখনই ভারত-অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড রেলিগেটেড হবে না; হ্যাঁ, র্যাঙ্কিংয়ের তলানিতে নামলেও না!
-কারণ?
তারা ক্রিকেটের অভিজাত। তাই আজীবন প্রমোশন!
হিসাবটা খুব পরিষ্কার-আগামী ২৮-২৯ জানুয়ারি দুবাইয়ে আইসিসির সভায় এই প্রস্তাব পাস হলে বিশ্বক্রিকেটে সবচেয়ে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হবে বাংলাদেশ। সেটা ভারতও জানে। বিসিবির তো আরও ভালো জানার কথা। কিন্তু ভারত লোভের মুলো ঝুলিয়েছে বাংলাদেশের সামনে। বলেছে-এখন ক্রিকেট থেকে বাংলাদেশ যা পাচ্ছে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি নগদ নারায়ণ তারা পাবে এই প্রস্তাবের পক্ষে সায় দিলে। বৃহস্পতিবার বিসিবির সভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ পরিচালক এই আর্থিক লোভের কাছে পরাজিত। অথচ এই ‘বিনিময়’-এ বাংলাদেশ হারাবে তাদের টেস্ট ক্রিকেট!
বিসিবি অর্থের বিনিময়ে টেস্ট ক্রিকেটকে বেঁচে দিচ্ছে-সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীরা এখন এই অভিযোগ তুলতেই পারেন। বিসিবির সাবেক সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী তো আরও কড়া অভিযোগ করেছেন। কাল বিসিবির বর্তমান সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের কাছে একটা লম্বা প্রতিবাদীপত্র ই-মেইল করেছেন সাবের হোসেন চৌধুরী। তাতে সাবের হোসেন লিখেছেন-‘টেস্ট মর্যাদা অর্জনে আমরা অনেক আত্মবিশ্বাসী ও সাহসী ছিলাম। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলছি এখন সেই মর্যাদা রক্ষা করার মতো গুণাবলি ও নেতৃত্বের অভাব দেখছি। স্বল্প মেয়াদের জন্য সামান্য কিছু আর্থিক সুবিধাদির বিনিময়ে আমরা ক্রিকেটের অস্তিত্বকে বিক্রি করতে পারি না। কিন্তু কি দেখলাম আমরা? বোর্ড সদস্যরা এই বিক্রির পক্ষেই ভোট দিলেন! গর্বের সঙ্গে আমরা যে টেস্ট মর্যাদা অর্জন করেছিলাম সেটা এখন হারাতে বসেছি। এটা কোনোমতেই মেনে নেওয়া যায় না। বলতে বাধ্য হচ্ছি-বিসিবির পরিচালকরা এই যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেটা কোনোমতেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের স্বার্থের পক্ষে যায় না এবং এটা পুরোপুরি আমাদের জাতীয় স্বার্থেরও পরিপন্থী। বিসিবি তো বাংলাদেশ ক্রিকেটের রক্ষক। অথচ সেই চেয়ারে বসে তারা তো এই ক্রিকেট খুন করতে পারেন না! আইসিসির তিন পূর্ণ সদস্য দেশের প্রস্তাবনা পাসের বিষয়ে বিসিবির পরিচালকরা সভা করে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন-সেটা আর কিছু নয়, বাংলাদেশ ক্রিকেটের মৃত্যু পরোয়ানায় সই!’
দীর্ঘ চিঠিতে সাবের হোসেন চৌধুরী আশা করেন বিসিবি তাদের এই বোর্ডসভায় নেওয়া ভুল সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে সঠিক পথটা বেছে নেবে। তিনি লেখেন-‘তিন পূর্ণ সদস্যের এই প্রস্তাবনার বিপক্ষে বিসিবির উচিত শক্তিশালী ও দৃঢ় গলায় প্রতিবাদ করা। নাজমুল হাসান পাপন যদি সেটা করতে না পারেন তবে তিনি বোর্ড সভাপতি হিসেবে ব্যর্থ। দেশের ক্রিকেটের রক্ষাকবচের দায়িত্ব নেওয়া গোটা বিসিবিও সেই ব্যর্থতার কাতারে পড়বে।’
বৃহস্পতিবার বিসিবির বৈঠকে ষড়যন্ত্রের এই প্রস্তাবনা পাসের পক্ষে ভোট পড়ে ২০টি। আর প্রস্তাবনার বিপক্ষে ভোট দেন ৩ জন। এই তিনজন হলেন আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি, তানজীল চৌধুরী ও শওকত আজিজ। প্রতিবাদী এই তিন ক্রিকেট সংগঠককে স্যালুট-আর বাকি ২০’র জন্য একরাশ করুণা!
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশ সেই প্রথম দিন থেকেই ভারতকে পরম বন্ধুর সম্মান দিয়ে আসছে। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই সেই বন্ধুত্বের সব দায়ভার বাংলাদেশ একা চুকিয়ে এসেছে। টেস্ট খেলুড়ে ৯ দেশেই বাংলাদেশ টেস্ট সিরিজ খেলে এসেছে। কিন্তু টেস্ট মর্যাদা অর্জনের এক যুগেরও বেশি হয়ে গেল এখন পর্যন্ত ভারত তার দেশে বাংলাদেশকে টেস্ট খেলার ‘দাওয়াত’ই দিল না!
অথচ বাংলাদেশের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী ভারত। একপাক্ষিক মিত্রতাকে ভারত কি কখনও দ্বিপাক্ষিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে?
টেস্ট ক্রিকেটে বিশ্বস্বীকৃত ডিআরএস পদ্ধতি সব দেশ মেনে চলে। কিন্তু ভারত সেটা মানে না। সফরে কিছু কাটছাঁট করায় কিছুদিন আগে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ক্রিকেট সিরিজ বাতিল করে ভারত। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারত দ্বিপাক্ষিক ক্রিকেট খেলছে না। এখন তারা বলছে-আইসিসিকেও মানে না।
বিশ্বক্রিকেটে আমরাই সবচেয়ে বেশি ডলার আয় করি-তাই প্রতি চার বছর পরপর যে বিশ্বকাপ হয় তাতে আমরাই চ্যাম্পিয়ন।
হ্যাঁ-না খেলেই!
ভারত কবে এই দাবি করে সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা!
- লেখাটি ২৫ জানুয়ারি দৈনিক সকালের খবরে ছাপা হয়েছে। লেখক পত্রিকাটির ক্রীড়া সম্পাদক এম. এম. কায়সার
Discussion about this post