ভারতীয় ক্রিকেটে শেষ হল শচীন টেন্ডুলকার অধ্যায়। শনিবার বিদায় বললেন এই কিংবদন্তি। এই সময়ে চলুন শচীনের ডায়েরি থেকে জেনে নেই এক কিংবদন্তি হয়ে উঠার পেছনে যারা ছিলেন তাদের কথা। শচীনের জবানীতেই পুরোটা তুলে ধরা হল এখানে-
আমার খেলার সঙ্গী
আসলে আমি ভাগ্যবান একজন মানুষ। আমার বড় ভাই অজিতের মতো দাদা কেউ পেয়েছে কি না সন্দেহ। আসলে ও আমার শুধুই বড় ভাই নয়, বন্ধু আর পথ প্রদর্শকও। আমরা তিন ভাই আর এক বোন।
আমার বড় দাদা অজিতও ভালো ক্রিকেট খেলত। শিবাজি পার্কে ওর খেলা দেখে অনেকেই মুগ্ধ হয়েছে। আসলে আমাকে গড়তে গিয়ে ওর আর খেলা হয়নি। আমিও ওর দেখাদেখি ভর্তি হই বলমোহন বিদ্যা মন্দিরে। কিন্তু দাদা যখন খোঁজ নিয়ে জানতে পারল পাশের সারদাশ্রম স্কুলে ক্রিকেট খেলার চর্চাটা বেশি হয়, তখন আমাকে সে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিল। ওখানেই পরিচয় আমার ক্রিকেট গুরু রমাকান্ত আচরেকারের সঙ্গে।
যখন পেছন ফিরে দেখি তখন অবাক হই কী দূরদর্শী না ছিল আমার দাদা। আমার ব্যাটিংয়ের দুর্বল দিকগুলো সবচেয়ে বেশি জানাত দাদাই। তখন থেকেই ব্যাটিং নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলত। এখনও কোনো সমস্যা হলেই আমি ছুটি দাদার কাছে। পেয়ে যাই সহজ সমাধান।
আমার সবচেয়ে বড় ভাই নিতিন। বোনও আমার বড়। তাই তো আদরেই বেড়ে উঠেছি।
সাতাশির বিশ্বকাপের সময় সুনীল গাভাস্কার আমাকে ড্রেসিংরুমে নিয়ে কয়েকজন ক্রিকেটারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। আমার কাছে সেটা বিরাট দিন ছিল। তখন কে জানত এই ওয়াংখেড়েতে জীবনের আরও বড় একটি দিন দেখতে পাব। আমি মনে করি ২ এপ্রিল বিশ্বকাপ জেতার দিনটিই আমার জীবনের সেরা দিন।
বাবা
আমাকে জানতে হলে প্রথমেই বুঝতে হবে আমার বাবাকে। কারণ আজকের এই শচীন রমেশ টেন্ডুলকারের প্রধান শেফ তিনিই। আমার ক্রিকেট জীবনে আমার প্রয়াত বাবার ভূমিকাটাই সবচেয়ে বেশি। বাবা রমেশ টেন্ডুলকার ছিলেন শান্ত এক মানুষ। তার চিন্তা-চেতনাও বেশ পরিষ্কার। এখনও আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমাদের যৌথ পরিবারের কেউ কোনো সমস্যায় পড়লেই ছুটে আসতেন বাবার কাছে। বাবাকে কখনও ধৈর্যহারা হতে দেখিনি। আরেকটা ব্যাপার আমাকে অবাক করত যে, জগতের এসব পার্থিব বিষয়ের প্রতি কোনো মোহই ছিল না তার। কিন্তু তাই বলে সংসার-বিবাগী নন।
আসলে বাবার একমাত্র আগ্রহ ছিল ওই সাহিত্যচর্চা আর পাঠ। আমার স্ত্রী অঞ্জলি তো এখনও আমাকে বাবার মতো হতে বলে। আমি হাসি, বাবার মতো এমন মানুষ হওয়া সহজ নয়!
বাবা কখনই পাশে বসে আমাকে দীর্ঘ সময় উপদেশ দেননি। আসলে তার জীবনধারাই আমাকে প্রভাবিত করেছে বারবার। বাবা একটা কথা প্রায়ই আমাকে বলতেন, ‘তেন্ডালা (আমার ডাক নাম) সাফল্যে কখনই আÍহারা হয়ে উঠিস না। আবার ব্যর্থতা ঘিরে ধরলেও ভেঙে পড়বি না। আসলে সাফল্য আর ব্যর্থতা দুটোই জীবনের স্বাভাবিক অংশ।’
যেমনটা বলেছিলাম, বাবা সবসময়ই সৌম্য, শান্ত, স্থির। আমি বাবাকে কখনই রেগে যেতে দেখিনি। এখনও মাঝে মাঝে বিস্ময়ে ভাবি এটা কী করে সম্ভব? একটা বড় পরিবারের পুরো দায়িত্ব কাঁধে নিয়েও এমন নির্ভার থাকা যায়? না, আমি এক বিন্দু বানিয়ে বলছি না। আসলে বাবার জীবনধারার অর্ধেকও যদি অনুসরণ করতে পারতাম, তবে জীবনের মানেটা আরও গভীর হয়ে ধরা দিত। তার শিক্ষাই আমাকে আজীবন পথ চলতে সাহায্য করবে।
বাবাকে প্রতিটা মুহূর্ত আমি অনুভব করি। তাই তো ক্রিকেট মাঠে সেঞ্চুরির পর ঈশ্বরের সঙ্গে ধন্যবাদ জানাই বাবাকেও!
আমার মা
আমার যত আবেগের জায়গায় আছেন আমার মা। মা কথাটা এতটাই মিষ্টি যে, ডাকলেই প্রাণভরে যায়। ছোট্ট ওই শব্দে যেন মধু লুকিয়ে আছে! আমার মা অন্যসব মায়ের মতোই স্নেহময়ী। নরম মনের মানুষও। আমার সন্তানরা এখন বড় হয়েছে। তারপরও আমার কিছু হলেই মা অস্থির হয়ে ওঠেন! ইনজুরিতে পড়লে তো মায়ের উদ্বেগের শেষ নেই। সারাক্ষণই চলতে থাকে প্রার্থনা।
মাকে নিয়ে একটা ঘটনার কথা বলতেই হবে। তখন আমি অনেক ছোট। পড়াশোনা আর খেলার জন্য আমি শিবাজি পার্কের কাছে কাকার বাড়িতে থাকি। সেখান থেকে সাহিত্য সহবাস কলোনির দূরত্বটা অনেক। মা তখন কাজ করতেন সান্তাক্রুজের অফিসে। তখন কাকার বাসায় থেকেছি প্রায় চার বছর। ওই সময়টাতে প্রতিদিনই অফিস শেষে মা আমাকে দেখে তারপর বাসায় ফিরতেন। প্রতিদিন আমার মুখটা না দেখলে নাকি মার ঘুমই হয় না!
এখন আমি নিজেই বাবা। বেশিরভাগ সময়ই ব্যস্ততার কারণে সন্তানদের সময় দিতে পারি না। তখন বুঝতে পারি আমার মা আমাকে কী দিয়েছেন। মায়ের ঋণ আসলে শোধ করা যায় না!
আমাকে ঘিরে ভক্তদের উচ্ছ্বাস আর যত জাঁকজমক থাকুক না কেন, মায়ের কাছে এখনও আমি সেই ছোট্টটি আছি। যেন সেই স্কুলপড়–য়া তেন্ডালা…
কাকা-কাকি
সুরেশ কাকা বাবার ছোট ভাই। তার স্ত্রী মঙ্গলা কাকি। আমার কৈশোরের মূল্যবান চারটি বছর কেটেছে তাদের স্নেহ, আদর আর শাসনে। বাবা আর মায়ের পরই আমার হদয়ে তারা। আমার আজকের এ সফলতার পেছনে কিন্তু ওদের রয়েছে অনেক অবদান। তাদের কাছে আমি যেন সন্তানের চেয়েও বেশি। কোনো কষ্টই আমাকে তারা বুঝতে দেয়নি। এখনও তারা আমাকে সেই আগের মতোই ভালোবাসে। সবার এমন ভালোবাসায় চোখ ভিজে আসে! আমি সত্যিই ভাগ্যবান।
অঞ্জলির ভালোবাসা
২২ পেরোনোর পর যখন আমি বিয়ের সিদ্ধান্তটা নেই তখন অবাক হয়েছিলেন অনেকেই। আমাদের সমাজে সেটাই তো স্বাভাবিক। অনেকেই বলছিলেন আমার মতো ক্রিকেট পাগল একজন মানুষ সাংসারিক এ জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে তো? কেউ কেউ তো বলেই দিয়েছিলেন শেষ হয়ে যেতে পারে আমার ক্যারিয়ার।
কিন্তু একটা সময় সবার ভুল ভাঙে। আমাকে সবসময় সজীব রাখতে আসলেই অঞ্জলিকে প্রয়োজন ছিল। ওকে যত দেখি ততই অবাক হই। কীভাবে একটা মানুষ সবার সঙ্গে এমন করে মানিয়ে চলতে পারে?
আসলে শুরুতে আমি নিজেও ভাবতাম অঞ্জলি পারবে তো? ওর মা ব্রিটিশ। বাবা গুজরাটি। লন্ডনে বাড়ি আছে ওদের। আবার মুম্বাইয়ে সবচেয়ে অভিজাত এলাকায় থাকত ওরা। আমাদের পরিবারের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটা সহজ ছিল না। আমাদের সাহিত্য সহবাসের কলোনিটাই ও নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছে। আমাদের পুরো পরিবারটা ভালোবাসা দিয়ে এক সুতোয় গেঁথে রেখেছে ও।
অঞ্জলি পেশায় ডাক্তার। ছাত্রী হিসেবে অসাধারণ। মেডিক্যালে গোল্ড মেডেলিস্ট। ও গুজরাটি, মারাঠি, ইংরেজি আর হিন্দি ভাষা জানে। তবে আমরা হিন্দি আর ইংরেজিতেই কথা বলি।
বিয়ের পর আমার ক্রিকেটের ক্ষতি হবে এই ভেবে বাসাতেই থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। এ পরিবারে ও পুরো শ্রম ঢেলে দিয়েছে বলেই এটি হয়ে উঠেছে দেশের আদর্শ একটি পরিবার।
ক্রিকেট ক্যারিয়ারে যখনই হতাশা আর কষ্ট আমাকে পুড়িয়েছে, সবার আগে পাশে পেয়েছি অঞ্জলিকে। বন্ধুর মতো এগিয়ে এসেছে ও। হতাশা, ক্ষোভ আর দুঃখ যখন গ্রাস করতে যাচ্ছিল তখন অঞ্জলি শীতলতার পরশ হয়ে এসেছে বারবার। যখন টেনিস এলবো ইনজুরি ধাক্কা আমার ক্যারিয়ার শেষ হওয়ার আশঙ্কা হচ্ছিল তখন সবচেয়ে বেশি সাহস জুগিয়েছে অঞ্জলিই। ও পাশে না থাকলে হয়তো হালই ছেড়ে দিতাম। আসলে ব্যাটই তো তুলতে পারতাম না তখন। কিন্তু ওর ভালোবাসা আর সঠিক পরিচর্যাতেই সেরে উঠেছি আমি। আমার আজকের এ সাফল্যের পেছনে ওর রয়েছে বড় ভূমিকা।
অঞ্জলি আমার জীবনে আশীর্বাদ। ওকে ছাড়া আমার চলত না।
আমার দুই সন্তান
অর্জুন আর সারাহ যেন আমার শরীরের অংশ। আমার হদয়। আসলে বাবা হিসেবে আমি কেমন সে সার্টিফিকেট দেবে স্ত্রী অঞ্জলি এবং আমার দুই সন্তান অর্জুন আর সারাহ। জানি না ওরা কী বলবে?
কিন্তু ব্যস্ততার কারণে ওদের একেবারেই সময় দিতে পারি না আমি। এজন্য খুব কষ্টে ভুগি। যদিও এ নিয়ে ওদের কোনো অভিযোগ নেই। ওরা জানে ওদের বাবা দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলছে। আমার মেয়ে সারাহ এখন অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে। বড় হয়ে উঠেছে ও। যখন আমি কনুইয়ের ইনজুরিতে ভুগেছি, সারাহ মাউন্ট মেরি চার্চে গিয়ে প্রার্থনা করেছে আমার জন্য। আর অর্জুন বারবারই ছুটে এসে আমাকে বলেছে, ‘বাবা তোমার হাতে অনেক ব্যথা? আমি মালিশ করে দেব?’ ওর আদরমাখা এমন কথায় চোখে জল এসে গিয়েছিল আমার।
আমার দুই সন্তানের দিকে তাকালে মনে হয় জীবনের সেরা অর্জন বুঝি ওরাই! আমি ওদের বাবা! কোনো তারকা নই!
আমার গুরু
এ কথা আমাকে বারবারই বলতে হবে-আমি যারপরনাই ভাগ্যবান। জীবনের শুরুতেই আমি পেয়েছিলাম রমাকান্ত আচরেকারের মতো একজন কোচ। আমার ক্রিকেট জীবনকে প্রথমে ছাঁচে ফেলে আকার দিয়েছেন তিনিই। আমি ওনাকে স্যার বলি। ক্রিকেট জীবনের শুরুতে আমার ওপর সবসময় নজর থাকত উনার। ভুল-ত্র“টি শুধরে দিতেন সবসময়। যখনই কোনো ম্যাচ খেলে আসতাম, কম সময়ই তিনি জানতে চাইতেন কত রান করেছ? বরং জানতে চাইতেন কীভাবে আউট হয়েছি আমি। তবে রেগে না গিয়ে আমাকে বুঝাতেন কীভাবে সামলে উঠতে হবে এ ভুল। আবার নিয়ম-শৃঙ্খলার ব্যাপারটাও তার কাছ থেকে শেখা।
এই যে এখনও আমার রান ক্ষুধা মরে যায়নি তার অবদান কিন্তু রমাকান্ত স্যারেরই। তিনিই বলেছিলেন, ‘একজন ব্যাটসম্যানের মনে কখনই তৃপ্তি আসা উচিত নয়।’ যখনই মাঠে নামি স্যারের ওই কথা বারবার আমার কানে আসে।
স্যার আমি এখনও সেই শিবাজি পার্কের তেন্ডলাই আছি…
http://youtu.be/CfCBWUkWzXM
Discussion about this post