পূর্ব পাকিস্তান ক্রিকেটে তিনি যেন ছিলেন চিত্রকর লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি “। ভিঞ্চি যেমন তুলির আচড়ে শৈল্পিক সব ছবি আঁকতেন তেমনি মাঠের সবুজ ঘাসের ২২ গজের পিচে ব্যাট হাতে তিনি দক্ষ শিল্পীর মত অপূর্ব সব শটের পসরা সাজাতেন। সে সময় তার মত ভাল “স্লগ সুইপ” আর কে খেলতে পারত ? ডানহাতি স্টাইলিশ ওপেনার আর উইকেটকিপার হিসেবে আজাদ বয়েজ, মোহামেডান স্পোটিং ক্লাব এবং ইস্ট পাকিস্তান প্রভেনসিয়াল দল এর হয়ে আক্রমনাত্মক ব্যাটিংয়ে নিয়মিত মাঠ মাতিয়েছেন।
কায়েদে আযম ট্রফিতে জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসান আর তিনি থাকতেন নিয়মিত রুমমেট। ক্রিকেট রোমান্টিকরা তার ব্যাটিং জাদুতে মুদ্ধ হয়ে বলতেন ” পাড়ার ক্রিকেটের জন্য নয়, বরং জাতীয় দলে খেলার জন্য এই ছেলের জন্ম হয়েছে “। তিনি শহীদ আব্দুল হালিম চৌধুরী জুয়েল- বীর বিক্রম। সবার কাছে যিনি জুয়েল নামেই বেশি পরিচিত।
১৯৫০ সালের ১৮ জানুয়ারি মুন্সিগঞ্জ জেলার ওয়াজেদ চৌধুরী-ফিরোজা বেগম এর কোল এর জুড়ে এলেন জুয়েল। তিন ভাই আর চার বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। ক্রিকেট আর জুয়েল যেন ছিলেন সমর্থক শব্দ । ১৯৬৭ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে ক্রিকেট খেলার পাশাপাশি একটি ক্যামিকাল কোম্পানীতে চাকরী নেন তিনি। দেশের হয়ে সর্বেচ্চ পর্যায়ে খেলার যোগ্যতা থাকা সত্বেও সেই সময় পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্যের স্বীকার হন তিনি, যা তার মনে গভীর দাগ কাটে।
পূর্ব পাকিস্তান এর ক্রিকেট অঙ্গনে একটি প্রিয় নাম ছিল আজাদ বয়েজ ক্লাব। এই ক্লাব প্রতিষ্ঠা হয়ে ছিল ক্রিকেটে নিবেদিত প্রাণ মুশতাক আহমেদ এর হাতে। আর্থিক অনটনে থাকা সত্বেও প্রবল ইচ্ছা শক্তি ও অন্যান্যদের সহযোগিতায় তিনি এই ক্লাবটি প্রতিষ্ঠা করেন। দিনরাত ক্লাবেই পড়ে থাকতেন, বন্ধুদের কাছে তিনি ছিলেন ” সংসার বিবাগী মানুষ “।নিজ পরিবার বলতে তিনি আজাদ বয়েজকেই বুঝতেন।একজন সংগঠক হিসেবে ক্লাবকে ঘিরেই তার সব ধ্যান জ্ঞান ছিল। “ক্রিকেট-সন্ন্যাসী ” কথাটা তাই মুশতাক আহমেদের নামের পাশে বেশ মানিয়ে যায় । আজাদ বয়েজের হয়ে খেলার কারনে মুশতাক আহমেদের প্রতি জুয়েল এর ছিল প্রগাঢ় ভালবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ।
এসে যায় উত্তাল ৭১। ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা টেস্টে রকিবুল হাসান তার ব্যাট এ “জয় বাংলা” লিখা স্টীকার লাগিয়ে ক্রিকেট ময়দানে প্রতিবাদেও ঝড় তোলেন।
২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্থানি হানাদাররা এদেশে শুরু করে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা। এই গণহত্যা থেকে রেহাই পাননি ক্রিকেট সংগঠক মুশতাক আহমেদ ও। পাকিস্তানিদের বুলেট ঝাঝড়া করে দেয় তার শরীর। ক্লাব অন্ত:প্রান মানুষটির মৃত দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায় ঢাকা ডিভিশন স্পোর্টস এসোসিয়েশন এর প্যাভিলিয়নের একটি ঘরে। দুদিন এভাবেই অবহেলায় হয়ে পড়ে ছিল তার ক্ষতবিক্ষত শরীরটা।
২৭ শে মার্চ জুয়েল, সৈয়দ আশরাফুল হক (বর্তমানে এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল এর চীফ এক্সিকিউটিভ) কে সাথে নিয়ে সনাক্ত করেন সদাহাস্যজ্জ্বল শহীদ মুশতাক আহমেদের লাশ। প্রিয় মানুষের ক্ষতবিক্ষত লাশ তাতিয়ে দেয় জুয়েলকে। তার মনে দ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে, মাথায় খুন চাপে, রক্তে ধ্বংস নাচে, বুকের ভিতর অনুভূত হয় দেশের জন্য লড়ার তাগিদ । চটজলদি ব্যাট-প্যাড তুলে রেখে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে হাতে স্টেনগান তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন জুয়েল।
ভারতে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় মায়ের “মাতৃসুলভ স্নেহ”। মা যে বুকের ধন কে কিছুতেই হাত ছাড়া করতে চাননা। কিন্তু রক্তে যার দেশ কে স্বাধীন করার নেশা তাকে থামায়, সাধ্য কার? ডানপিটে জুয়েল কে তাই কোন মায়ার বাঁধনেই বেঁধে রাখা যায়নি, বাউন্ডুলে জীবনে গাঁটছড়া বাঁধেননি কারো সাথেই। উত্তাল ৭১ এ গৃহত্যাগী হয়ে প্রশিক্ষনের জন্য ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মেলাঘরে পাড়ি জমালেন জুয়েল। ৩১ মে, কেউ কে কিছু না বলে চুপি চুপি ঘর ছাড়ার বেশ কিছু দিন আগে মা কে ফ্রেমে বাঁধানো নিজের ছবি দিয়ে বলে ছিলেন ” আমি যখন থাকব না, এই ছবিটাতে তুমি আমাকে দেখতে পাবে “।
ভারতে সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের তত্ত্বাবধায়নে ২ নম্বর সেক্টরে ট্রেনিং শেষে দেশে ফিরলেন তিনি। প্রশিক্ষন প্রাপ্ত ভারত ফেরত জুয়েল তখন আর বোলারদের পিটিয়ে নাকের জল চোখের জল এক করে দেয়া ব্যাটসম্যান নন বরং গেরিলা যোদ্ধা। বদিউজ্জামান, আলম, পুলু, সামাদ সহ অনান্যদের সাথে তিনিও যোগ দিলেন মুক্তিবাহিনীর ক্র্যাক প্লাটুনে। শুরু হয় তাদের গেরিলা অপারেশন। আক্রমনাত্মক ব্যাটসম্যান জুয়েল যেন যুদ্ধের ময়দানে আরো আক্রমনাত্মক।
ক্রিকেট ব্যাটের মত অস্ত্র ও সমান দক্ষতায় চালাতে পারতেন। ঢাকার ফার্মগেট, এলিফ্যান্ট রোডের পাওয়ার স্টেশন, যাত্রাবাড়ী সহ একাধিক এলাকায় অতর্কিত হামলায় দিশেহারা করে দেন পাক সেনাদের।
একটি গেরিলা অপারেশন থেকে নৌপথে ফেরার সময় রাজাকার ও পাকবাহিনীর অতর্কিত বুলেটের আঘাতে জুয়েলের হাতের তিনটি আঙ্গুলে মারাত্মক জখম হয়েছিল। ক্রিকেটার জুয়েলের মনে তখন আতংক ” এই হাত দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ক্রিকেট খেলতে পারব তো ” ?
আহত হয়ে জুয়েল, বড় মগবাজারে আজাদ এর বাসায় চিকিৎসাধীন ছিলেন। রাজাকার মারফত এই খবর পৌঁছে যায় পাকিস্তান হানাদারদের কাছে। ২৯ আগষ্ট ঐ বাসায় হানা দিয়ে পাকিস্তানি সেনারা আটক করে জুয়েল, আজাদ সহ আরও অনেকে। জুয়েলের মুখ থেকে কথা বের করার জন্য ব্যান্ডেজে বাধা ভাঙ্গা আঙ্গুল মোচড়াতে থাকে পাক সেনারা। জুয়েলের বুক ফাটা আর্তনাদে ভারী হতে থাকে ঢাকার আকাশ, সেই আর্তনাদে মিলিয়ে যেতে থাকে স্বাধীন বাংলাদেশে ক্রিকেট খেলতে চাওয়া এক ক্রিকেটারের স্বপ্ন।
৩১ আগষ্টের পর আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি জুয়েলের। ধারনা করা হয় ৩১ আগষ্টেই তাকে মেরে ফেলা হয়। ১৬ ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। একটি লাল-সবুজ পতাকা পাওয়া গেল। যে লাল রংয়ের ভিতর মিশে ছিল জুয়েলেরও লাল টকটকে তাজা রক্ত ।এক সময়ের টিমমেট রকিবুল হাসান বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক হলেন, শুধু জুয়েল আর ফিরলেন না মাঠের ২২ গজের পিচে। স্বাধীন বাংলাদেশে ক্রিকেট খেলার স্বপ্নটা তার কর্পূরের মতোই মিলিয়ে গেল। ক্রিকেট রোমান্টিকদের কাছে তিনি তখন ” ফ্রেমে বাঁধা এক ছবি “।
মুক্তিযুদ্ধে জুয়েলের বীরত্বের জন্য ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে শহীদ জুয়েল কে মরনোত্তর সন্মাননা প্রদানের ঘোষনা দেয় বাংলাদেশ সরকার।১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার জুয়েল কে মরনোত্তর “বীর বিক্রম” খেতাবে ভূষিত করে।১৯৭৩ সালের সরকারী গেজেটে জুয়েলের বীরত্বভূষন সনদ নম্বর ১৪৮।
শহীদ জুয়েল আর শহীদ মুশতাকের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ৭০ দশক থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড প্রতিবছর ১৬ ই ডিসেম্বর শহীদ মুশতাক একাদশ বনাম শহীদ জুয়েল একাদশ নামে একটি প্রীতি ম্যাচের আয়োজন করে থাকে। প্রায় তিন যুগ পর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এর তৎকালীন পরিচালক আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি’র প্রস্তাবক্রমে দুই শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মিরপুর শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম-এ দুটি স্ট্যান্ড এর নাম শহীদ জুয়েল স্ট্যান্ড এবং শহীদ মুশতাক স্ট্যান্ড করা হয়।
শহীদ জুয়েলের স্বাধীন বাংলাদেশে ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন পূরন হয়নি, শহীদ মুশতাকের ক্রিকেট নিয়ে স্বপ্নগুলোও ছিল অসম্পূর্ণ, তাতে কি? আজ না থেকেও দুজনে জড়িয়ে আছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের সাথে। উত্তরসূরীদের কাছে রেখে গেছেন গর্ব করার মত তাদের বীরত্বগাঁথা ইতিহাস। উঠতি কোন ক্রিকেটারের কাছে তাদের বীরত্বগাঁথা তাই যেন সঞ্জিবনী সুধা।
ক্রিকেট বিশ্বে স্বাধীন বাংলাদেশের পদচারনা, বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া, ঘরের মাঠ বিশ্বকাপ আয়োজন কিংবা ক্রিকেট কে ঘিরে সারা দেশের মানুষের একেই ছাদের নীচে আসা, কিছুই দেখা হয়নি শহীদ জুয়েল-মুশতাকদের।
তবে বাংলাদেশ যখন খেলে অদৃশ্য থেকে দুজনে নিশ্চয়েই উপস্থিত থাকেন গ্যালারীতে।হয়ত মুগ্ধ নয়নে উত্তরসূরী মাশরাফি, মুশফিক, সাকিব, তামিম-দের এগিয়ে যাওয়া দেখেন।হয়ত না ফেরার দেশ থেকেই বলেন” আমরা যে স্বপ্নগুলো পূরন করতে পারিনি, তোমরা সেগুলো পূরন করবে নিশ্চয়ই । তোমাদের দিকে যে বুকভরা আশা নিয়ে তাকিয়ে আছি আমরা “।এই স্বপ্নের পথ ধরেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ টিম, শহীদ জুয়েল -মুশতাক আর কোটি কোটি বাঙ্গালির স্বপ্ন পূরনের লক্ষ্যে ।
সুত্র: বিসিএসএ টাইগার্স ফেসবুক ফ্যানপেজ
Discussion about this post