একজন সাধারণ ক্রিকেট অনুরাগী হিসেবে আমি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের আসন্ন নির্বাচনে অংশ নেয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলাম। এই নির্বাচন নিয়ে সীমাহীন অনিয়মের পরও বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের নানা অব্যবস্থাপনার বিপক্ষে আমি একটি দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার আগ্রহ থেকেই আমার নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া। এজন্য আমাকে প্রায়ই নানা হুমকি ধামকি শুনতে হয়েছে। নির্বাচনের সময় যত এগিয়ে এসেছে এই হুমকির মাত্রা ততই বেড়েছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে কুক্ষিগত করার জন্য একটি মহল শুরু থেকেই তৎপর এবং আমি নিশ্চত তারাই আমাকে এই হুমকি-ধামকিগুলো দিয়েছে। বিসিবির নির্বাচন নিয়ে তাদের এই মরিয়া মনোভাবই প্রমান করে কোন সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কিংবা বাংলাদেশ ক্রিকেটকে সেবা দেওয়ার মনোভাব নিয়ে তারা বিসিবিতে আসছে না। অর্থ লিপ্সাসহ ব্যক্তিগত নানা স্বার্থসিদ্ধিই তাদের মুল উদ্দেশ্যে। এই মহলটি কাউন্সিলর মনোনয়ন সহ বিসিবি’র নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নানানভাবে প্রভাব বিস্তার করে এই নির্বাচনকে ইতোমধ্যেই চরম বিতর্কিত করে ফেলেছে। যে কারণে সাবেক বিসিবি সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী এই নির্বাচনে অংশগ্রহনের আগ্রহ প্রকাশ করেও শেষ পর্যন্ত সরে দাড়িয়েছেন। কাউন্সিলরদের আরও একটি বড় অংশ এই নির্বাচন বয়কট করছে। নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে তার পক্ষপাতদুষ্ঠ আচরণের জন্য তাদের কাছে অভিযুক্ত হয়েছেন। এমন অবস্থায় এই ছকে সাজানো নির্বাচনে অংশ নিয়ে আমি একে নৈতিক কোন বৈধতা দিতে রাজি নই। তাই ক্রিকেট প্রশাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকার তীব্র ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আমি এই নির্বাচন থেকে সরে দাড়িয়েছি।
আমি আত্মবিশ্বাসী ছিলাম নির্বাচনে অংশ নিলে নানা প্রতিকুলতার মধ্যেও আমি জয়ী হয়ে আসবো। কিন্তু জয়ের পর এই মহলের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে আমি নিজেকে ব্যবহত হতে দিতে চাইনি। ক্রিকেটের উন্নয়নে সত্যিকারের কোন ভূমিকা রাখার সুযোগ পেতাম কিনা তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এখন যারা এই পাতানো নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে গত একবছর তারাই নিয়ন্ত্রণ করেছে। এই এক বছরে বিসিবিতে অনেক অনিয়ম হয়েছে। অনেক আর্থিক কেলেংকারি হয়েছে। বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুন্ন হয়েছে। ভাবমুর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। নির্বাচিত হলে এসবের আংশিক দায়ভার আমাকেও বহন করতে হত।
তাই আমি এই বির্তকিত নির্বাচন থেকে সরে দাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
ক্রিকেট বোর্ডে নানাবিদ অনিয়মের কুফল হিসেবে বাংলাদেশ ক্রিকেট যে ক্রমেই অধঃপতনের দিকে যাচ্ছে এ সর্ম্পকিত আমার কিছু পর্যবেক্ষণ এখানে দেয়া হল:
(১)
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। যে কোন সময়ের চেয়ে এই সম্পর্কটা এখন ঠুনকো। পাকিস্তান, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড-প্রায় সবদেশের ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সম্পর্কটা এখন চরম বিদ্বেষপূর্ণ। অথচ এই বিদেশী ক্রিকেট বোর্ডগুলো একসময় বাংলাদেশ ক্রিকেটের অকৃত্রিম বন্ধু ছিল। বিশ্ব ক্রিকেটে লাগাতার কুটনৈতিক ব্যর্থতার কারণে বাংলাদেশ অপরাপর ‘ক্রিকেট বন্ধু’ দেশের সমর্থন হারিয়ে ফেলেছে। সামনের দিনে আইসিসি’র বোর্ড সভায় বিভিন্ন ক্রিকেট সংক্রান্ত বিষয়ে বাংলাদেশ নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে কিনা-তা নিয়ে আশংকা স্পষ্ঠত।
টেস্ট মর্যাদা নিয়ে নিত্যদিনই বাংলাদেশকে বিভিন্ন সমালোচনা ও শ্লেষপূর্ণ কথা শুনতে হচ্ছে। আইসিসিতে যেভাবে ক্রমাগত বাংলাদেশ ‘বন্ধুহারা’ হয়েছে তাতে এখন বহু পুরানো সেই প্রশ্নটা ফের উঠলে নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদা কঠিন সংকটে পড়বে। আশপাশ থেকে কারো সমর্থনই মিলবে না। বিসিবি কর্মকর্তাদের অদক্ষতা বাংলাদেশকে আজকের এই অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে।
(২)
২০১৪ সালের টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের আয়োজক বাংলাদেশ। অথচ এই বিশ্বকাপের মুলপর্বে বাংলাদেশ খেলতে পারবে কিনা- সেটা এখনো অনিশ্চিত! এই টুর্নামেন্টের মুলপর্বে খেলতে হলে বাংলাদেশকে বাছাই পর্বের বাধা টপকে আসতে হবেÑসেই তথ্য এতদিন পরে সবাই জেনেছে! নিজ দেশেই টুর্নামেন্ট অথচ সেখানে খোদ আয়োজক বাংলাদেশই যেন অনাহুত! বিসিবি কর্মকতারা সব জেনেও গদির মোহে তা চেপে গেছেন।
(৩)
২০১৪ সালের টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে বাংলাদেশকে খেলতে হবে আফগানিস্তান, আয়ারল্যান্ড ও জিম্বাবুয়ের মতো দলগুলোর বিপক্ষে। এই দলগুলোর সেরা ক্রিকেটাররা চলতি বছর বাংলাদেশের ঘরোয়া লিগে খেলছে। এখানকার উইকেট, আবহাওয়া, কন্ডিশন, প্রতিপক্ষের শক্তিÑসামর্থ, দুর্বলতা সবকিছু সম্পর্কে তারা একটা আগাম ধারণা পেয়ে গেছে এই লিগে খেলার সুবাদে। এইসব দেশের ক্রিকেটারদের বিশ্বকাপের আগে আমাদের ঘরোয়া লিগে খেলার সুযোগ করে দিয়ে বিসিবি তো নিজ হাতেই নিজেদের ক্ষতি করেছে! প্রতিপক্ষ এই তিনদেশের ক্রিকেটারদের অন্তত বিশ্বকাপের আগে এবারের মৌসুমের ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলতে দেয়ার অনুমতি দিয়ে মোটেও দুরদর্শিতার পরিচয় দেয়নি বিসিবি।
(৪)
প্রতিনিয়ত আমাদের ক্রিকেটারদের হেনস্তা করছে বিসিবি। ক্রিকেটারদের সঙ্গে বৈষম্যমুলক আচরণ করা হচ্ছে। অথচ এই ক্রিকেটারদের কারণেই আজকের ক্রিকেট বোর্ড। ক্রিকেটারদের সঙ্গে সংগঠকদের বিরোধ তৈরি করে বিসিবি সম্পর্কের এই কাঠামোকে আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছে। বেতন এবং পারিশ্রমিক নিয়ে হরহামেশা ক্রিকেটারদের বিভিন্ন মহল থেকে নানান ধরনের কুটক্তি শুনতে হচ্ছে। বিসিবির ভুল নীতির কারণে শ্রদ্ধা ও সš§ানের সম্পর্কে আজ ফাটল ধরেছে।
(৫)
বিসিবি পরিচালনার ভার পড়েছে এমনসব ব্যক্তিদের হাতে যাদের একটি প্রতিষ্ঠান চালানোর সামান্যতম অভিজ্ঞতাও নেই। আর তাই যখনই কোন ক্রিকেটীয় সংকট বা সমস্যা তৈরি হচ্ছে তখন তাৎক্ষণিকভাবে তার সমাধান মিলছে না। প্রায় প্রতিটি কাজে বোর্ড সভাপতির কাছে ছুটতে হচ্ছে বেশিরভাগ সাব-কমিটিকে। ক্রিকেটের সঙ্গে কোনদিন ন্যূনতম সম্পর্ক ছিল না এমন ব্যক্তিও এখন ক্রিকেট বোর্ডের নামি কর্তা! পেছনের নয় মাসে বর্তমান বোর্ড একটিও ইতিবাচক এবং ক্রিকেটবান্ধব কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।
(৬)
ক্রিকেট বোর্ড পরিচালনার ভার নিয়েই কর্তারা এখান থেকে ব্যবসায়িক সুবিধা নিচ্ছেন। প্রায় সবকাজই দেয়া হচ্ছে বিনা টেন্ডারে। বিশাল বাজেটের এসব কাজ বিনা টেন্ডারে মুখচেনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বাগিয়ে দিয়ে বিসিবির কর্মকর্তারা এখান থেকে টু-পাইস কামিয়ে নিচ্ছেন। বিসিবি থেকে এভাবে ব্যবসায়িক ফন্দি-ফিকির করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার বিষয়টা এখন ওপেন সিক্রেট। ক্রিকেট উন্নয়নের শ্লোগান দিয়ে বিসিবিতে আসা ভুঁইফোঁড় কর্মকর্তা ক্রিকেট বোর্ডকে নিজেদের ব্যবসা কেন্দ্রে পরিণত করে ফেলেছেন। মাঠ পরিচর্যার কাজ, ঘাস স্থাপনের কাজ, বিজ্ঞাপনের কাজ-ইত্যাদি কাজে বিসিবির বর্তমান কমিটির কয়েকজন কর্মকর্তার ভূমিকা এখন লুটেরার মত!
(৭)
যে কোন দেশের ক্রিকেটের আয়ের সবচেয়ে বড় অংশটা আসে খেলা সম্প্রচারের টিভি রাইটস থেকে। কিন্তু লজ্জাজনক বিষয় হচ্ছে বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রিকেটের টিভি রাইটস কেনার আগ্রহই দেখাচ্ছে না কেউ! অযোগ্য লোকজনের ভিড়ে ক্রিকেট বোর্ড ভরে গেছে। একটি টেষ্ট খেলুড়ে দেশের টিভি রাইটস কোন প্রতিষ্ঠান কিনতে চায় না-মার্কেটিংয়ে এর বড় অযোগ্যতা আর কি হতে পারে!
(৮)
টিভি স্বত্ব কেনা বাবদ ভারতীয় প্রতিষ্ঠান নিমবাসের সঙ্গে বাংলাদেশের পাওনা ২৭ মিলিয়ন ডলারের কোন সুরাহা আজও হল না। ক্রিকেট কর্তারা শুধু দুবাই-সিঙ্গাপুর যাওয়া আসা করছেন কিন্তু দেশের ন্যায্য পাওনা উদ্ধারে কোন সফলতা দেখাতে পারলেন না।
(৯)
বিপিএল এখন বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য বড় বদনাম। দেশে এবং বিদেশে সর্বত্রই বিপিএলের এই বদনাম ছড়িয়ে পড়েছে। বিপিএলের দলগুলো ক্রিকেটারদের টাকা দেয়া না-এই অভিযোগ তুলে এখন বাংলাদেশের ঘরোয়া লিগে খেলার আগে উন্নত বিশ্বের ক্রিকেটাররা দ্বিতীয়বার চিন্তা করে। অনেকেই খেলতে আসতেই চায় না। বিপিএলের দুটি আসরই ম্যাচ ফিক্সিং এবং পাওনা পরিশোধের ব্যর্থতা দুর্নাম বয়ে বেড়াচ্ছে। এই ব্যর্থতা এবং ভয়াবহ দুর্নামের জন্য মুলত দায়ি বিসিবির পেছনের দুটো বোর্ডের কিছু পরিচালক।
(১০)
ঘরোয়া আসরের ক্রিকেটেও বিসিবি স্পন্সর যোগাড় করতে গলদঘর্ম। ডেসটিনি-নিউওয়ে নামের হায় হায় টাইপের প্রতিষ্ঠান বিসিবির জাতীয় দলের স্পন্সর হয়েছে। নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থের কারণেই এসব চরম বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানকে বিসিবির সঙ্গে যুক্ত করেছেন ক্রিকেট কর্তারা। বিসিবির মার্কেটিং খাত এখন চরম সাংগঠনিক অব্যবস্থাপনার নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে।
(১১)
নির্বাচনের আগে বিসিবির গঠনতন্ত্র সংশোধনী নিয়ে যা হয়ে গেল সেটা নাটক ছাড়া আর কিছু নয়। স্বীয় স্বার্থে গঠনতন্ত্রে অযৌক্তিক কিছু বদল এনে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বিতর্কের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে।
(১২)
অনেক ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ম্যাচ ফিক্সিং অভিযোগের তদন্ত চুড়ান্ত করতে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হল। সেই ট্রাইব্যুনাল গঠনের ৪০ দিন পার হয়ে গেল কিন্তু এখনো কোন কাজই শুরু হল না। একটি বৈঠকও করতে পারল না ট্রাইব্যুনাল। বিসিবির সাংগঠনিক ব্যর্থতার বড় নজির এটা।
মোহাম্মদ লুৎফর রহমান বাদল
চেয়ারম্যান, গাজী ট্যাংক ক্রিকেটার্স
Discussion about this post