মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামের বৃষ্টিøাত নীল অ্যাথলেটিক্স ট্র্যাকে পুরুষদের ১০০ মিটার শেষ হতেই যুক্তরাষ্ট্রের জাস্টিন গ্যাটলিনের সেকি উচ্ছ্বাস আর লাফালাফি। কোথা থেকে একটা জাতীয় পতাকা জোগাড় করে গায়ে জড়িয়ে ট্র্যাকে দৌড়ে দর্শকদের অভিনন্দন জানাতে শুরু করলেন। তাহলে গ্যাটলিনই কি বিশ্ব অ্যাথলেটিক্সের সেরা ইভেন্ট পুরুষদের শতমিটারে এদিন স্বর্ণপদক জিতেছেন? কারণ এমন লাফঝাঁপ তো চ্যাম্পিয়নদেরই মানায়। আসলে মোটেই তা নয়। কারণ যে ইভেন্টে কিংবদন্তি হওয়ার পথে থাকা জ্যামাইকার উসাইন বোল্ট নামের এক গতিদানব থাকেন, সেখানে অন্য কারো দ্বিতীয় হওয়াই তো প্রথম হওয়ার মতো আনন্দের। চ্যাম্পিয়নের তকমাটা তো বোল্টের জন্য বাঁধা। তাই মস্কোতে শতমিটারে রৌপ্য জিতেও গ্যাটলিনের ওমন উল্লাস!
-তাহলে পুরুষদের শতমিটারে বিশ্বসেরা কে?
কে আবার-বোল্ট! বোল্ট! এবং বোল্ট!
হ্যাঁ, রোববার রাতে শতমিটারে তার হারিয়ে ফেলা বিশ্বসেরা আসন আবার ফিরে পেয়েছেন জ্যামাইকার বজ্রবিদ্যুৎ। ৯.৭৭ সেকেন্ড সময় নিয়ে মস্কোয় শতমিটারে স্বর্ণপদক জিতেছেন বোল্ট। যেটি ২০১১ সালে দায়েগুতে ডিসকোয়ালিফাইড হয়ে স্বদেশি ইয়োহান ব্লেকের কাছে হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। ৯.৮৫ সেকেন্ড সময় নিয়ে রৌপ্যপদক জিতেছেন গ্যাটলিন। ব্রোঞ্জ বোল্টেরই স্বদেশি নেস্তা কার্টারের। যিনি সময় নেন ৯.৯৫ সেকেন্ড। অ্যাথলেটিক্সের সেরা এ ইভেন্টে জ্যামাইকানদের আধিপত্য বোঝাতে এটুকুই যথেষ্ট যে, প্রথম পাঁচজনের মধ্যে চারজনই ক্যারিবীয় এ দ্বীপটির। তাও ইনজুরিতে নেই ব্লেক এবং ডোপ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে বাদ আসাফা পাওয়েল।
দৌড় শেষে বাড়তি কোনো উচ্ছ্বাস যেন ছিল না বোল্টের। দৌড়ের আগে এবং পরে যেমন চনমনে থাকেন ঠিক তেমনই। যেন জানতেন স্বর্ণপদকটা তারই। তবে সেই চিরপরিচিত তীর-ধনুক ছোড়ার ভঙ্গিটি করতে ভুল করেননি। পরে সাংবাদিকদের বলেছেন-‘আমি খুশি তবে আরও ভালো করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেমিফাইনালের পর পায়ে টান ধরে গিয়েছিল। কেন তা অবশ্য জানি না।’ বিশ্বরেকর্ড যে মাথায় ছিল না সেটিও স্বীকার করে নেন বোল্ট। বলেন-‘পায়ে টান ধরার পর যখন বুঝলাম বিশ্বরেকর্ড হবে না তখন শুধু জেতার কথা মাথায় রেখেই ফাইনালে নেমেছিলাম। তাই জিতেই আমি খুশি। জ্যামাইকায় আমার ভক্তরাও তাই। কারণ ওরা আমার জয় ছাড়া আর কিছু ভাবতে নারাজ।’
দৌড় শুরুর আগে ট্র্যাকে একটা অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি করেছেন বোল্ট। যেন ছাতা খুলছেন। লুঝনিকি স্টেডিয়ামে ঝিরঝিরি বৃষ্টিতে যেন আশ্রয়ের চেষ্টা। তার ঠিক ১০ সেকেন্ড পরই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে শতমিটারের স্বর্ণটা ফের পুরনো মালিকের আশ্রয়ে গিয়ে নিশ্চিন্ত। অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে বিশ্বরেকর্ডসহ পাঁচটি স্বর্ণের মালিককে এবার মস্কোয় কেউ কি ঠেকাতে পারবে-সেই প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছিল বেশ কয়েকদিন ধরেই। পাওয়েল ও ব্লেক তো ছিলেনই না, ছিলেন না যুক্তরাষ্ট্রের টাইসন গেও। তিনিও যে ডোপপাপী। তাই বোল্টের সামনে ছিল অন্যরকম চ্যালেঞ্জ। শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের পাশাপাশি ডোপ কেলেঙ্কারির দাগও মুছে দেওয়া। তাতে পুরোমাত্রায় সফল বোল্ট স্বমহিমায়, স্বমেজাজে।
একটাই ভয় ছিল দায়েগুর মতো ফলস স্টার্ট যাতে না হয়। সেটা হয়নি। গুলির শব্দ হওয়া মাত্র নিজের লেন থেকে ছিটকে বেরিয়েছেন বোল্ট। পিছিয়ে ছিলেন তার পাশের লেনেই থাকা গ্যাটলিনও। এমনকি ৫০ মিটার পর্যন্ত এগিয়েও ছিলেন এ মার্কিন অ্যাথলেট। পরের ১০ মিটারেও বোল্টের গায়ে গায়ে দৌড়েছেন গ্যাটলিন। কিন্তু তারপরই ওস্তাদের মার। বোল্টের বাজিমাত। বিদুৎগতিতে ছিটকে পেরিয়ে গেলেন গ্যাটলিনকে। তারপর বোল্টকে ধরা সাধ্য কার? শেষটা দেখে মনে হল যেন অনায়াসে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হলেন।
২০০৭ সালে ওসাকা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে যাত্রা শুরু কিং বোল্টের। মস্কোয় তার মুকুটে যোগ হল আরেকটি মুক্তো। ‘বোল্ট’ যুগে বাকিরা সব দ্বিতীয় হওয়ার জন্যই নামে, এটাই এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। বয়স এখন ২৬। আগামী ২০১৬ ব্রাজিল অলিম্পিকে বয়স হবে ২৯। ওই অলিম্পিকেও যদি ১০০, ২০০ ও ৪০০ মিটার রিলেতে ট্রেবল স্বর্ণপদক জিততে পারেন, তাহলে সর্বকালের সেরা অ্যাথলেট তকমাটা চিরকালের জন্যই বোল্টের নামের সঙ্গে জুড়ে যাবে তাতে নেই সামান্যতম সন্দেহ। বোল্ট নিজে যেমন বলেছেন-‘অবসরের পর আমার নামটা যেন মোহাম্মদ আলি, পেলে কিংবা মাইকেল জর্ডনের মতো কিংবদন্তিদের পাশে উচ্চারিত হয় এটাই স্বপ্ন।’
বোল্টের অর্জন
* বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সর্বাধিক পদক জেতার তালিকায় দুই নম্বরে থাকা মাইকেল জনসনকে স্পর্শ করেছেন বোল্ট। তার পদক সংখ্যা এখন ৮। যার মধ্যে ৬টি স্বর্ণ।
* ২০০৯ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ১০০ মিটারে বোল্টের ৯.৫৮ সেকেন্ড এখনও বিশ্বরেকর্ড।
* ২০০৯ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ২০০ মিটারে বোল্টের ১৯.১৯ সেকেন্ড বিশ্বরেকর্ড।
* জ্যামাইকার বিশ্বরেকর্ড গড়া (২০১২ অলিম্পিকে ৩৬.৮৫ সেকেন্ড) ৪০০ মিটার রিলে দলের সদস্য বোল্ট।
* বোল্ট প্রথম অ্যাথলেট যিনি পরপর দুটি অলিম্পিকে (২০০৮, ২০১২) ১০০, ২০০ ও ৪০০ মিটার রিলেতে স্বর্ণপদক জেতার ডাবল হ্যাটট্রিক করেছেন।
Discussion about this post