বলিউডের নির্মাতারাও পিছপা হবেন! এমন ‘অবিশ্বাস্য’ গল্পের সিনেমা এই আমলে হয় নাকি? কুড়ে ঘর থেকে রাজ প্রসাদে ওঠে আসার গল্পগুলো আজকাল বাজার পাচ্ছে না। সবাই চায় বাস্তবতার ছোঁয়া লাগুক রুপালী পর্দাতেও।
মহেন্দ্র সিং ধোনির যাপিত জীবনের গল্প বলিউডের চিত্রনাট্যকেও হার মানায়। এইতো আজ থেকে ১১ বছর আগেও তিনি ছিলেন রেলের টিকিট চেকার। বিহারের ছোট্ট গ্রাম লাভালির অতি সাধারন পরিবারের ছেলে ধোনি। দারিদ্রতার সঙ্গেই ছিল অহর্নিশ বসবাস। পড়াশোনাতেও তেমন আহমরি নন। কিন্তু তার স্বপ্ন ছিল আকাশ ছোঁয়া!
রেল বিভাগের হয়ে ক্রিকেট খেলতে গিয়েই লম্বা চুলের এই তরুন নজরে পড়ে যান সবার। অবশ্য ম্যাচ খেলতে গিয়ে চাকুরি হারিয়েছিলেন তিনি। সেটাই যেন জীবন বদলে দিল ১৯৮১ সালের ৭ জুলাই জন্ম নেওয়া ধোনির। এরপর সময়ের পথ পেয়ে ওঠে এসেছেন শীর্ষে। আর এ মুহুর্তে তিনি টাইম ম্যাগাজিনের রায়ে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালীদের তালিকায় ১০০ জনের মধ্যে উঠে এসেছেন! গল্পটা তো বিস্ময়করই!
বিহারের অনুর্ধ-১৯ দলে ধোনি খেলেছেন সেই ১৯৯৮-৯৯ সালে। এরপর বিহার জাতীয় দল হয়ে খেলতে খেলতেই ডাক মেলে ভারতীয় এ দলে। এরপর স্বপ্নের জাতীয় দল। তারপরের গল্পটাতো সবারই জানা।
ফুটবল ও ব্যাডমিন্টন খেলার দিকেও জোক ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেছে নিলেন ক্রিকেটই। একাধিক রেকর্ডও যোগ হয়েছে এই উইকেট কিপার ব্যাটসম্যানের নামের পাশে। দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে সফল অধিনায়ক তিনিই। শচীন টেন্ডুলকারের পর ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রিকেটার ধরা হয় তাকেই।
গত বৃহস্পতিবার রাতে আরও একবার ক্রিকেটবিশ্ব দেখল ধোনির দৃঢ়তা। ওয়েস্ট ইন্ডিজে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় ক্রিকেটের ফাইনালে জয়ের জন্য ভারতের তখন দরকার ১৫ রান। শ্রীলঙ্কার মাত্র ১ উইকেট। জয়ের জন্য শেষ ওভারটাকেই বেছে নিলেন ধোনি। অবশ্য সামিন্দা এরাঙ্গার ওভারের প্রথম বলে রান করা হয়নি। কিন্তু পরের বলেই হাওয়ায় উড়ালেন-ছক্কা! এরপর বাউন্ডারি। ম্যাচ হাতের মুঠোয়। চতুর্থ বলে ছক্কা হাঁকিয়ে দলকে এনে দেন ১ উইকেটের নাটকীয় জয়। ৫২ বলে ৪৫ রানের এমন ‘ম্যাজিকেল’ ইনিংস খেলে ম্যাচসেরা ধোনিই।
অবশ্য এমন মাথা ঠাণ্ডা রেখে খেলে যাওয়াটা ভারত অধিনায়কের জন্য নতুন নয়। কিছুদিন আগেই নতুন একটা দল নিয়ে জিতেছিলেন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। এবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে অবশ্য তার পিছু নিয়েছিল ইনজুরি। কিন্তু ফাইনালটা মিস করলেন না তিনি। নেমেই জয়ের নায়ক ধোনি।
এইতো এবার আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতে মহেন্দ্র সিং ধোনি ওঠে গেলেন ইর্ষনীয় উচ্ছতায়। অথচ বেশ চাপে থেকেই ইংল্যান্ডের এই টুর্নামেন্টে খেলতে গিয়েছিলেন তিনি। আইপিএলে গড়াপেটা ও গৌতম গম্ভীর, বীরেন্দ্র শেবাগ ও যুবরাজের মতো ক্রিকেটারকে দলে না রাখায় তীব্র সমালোচনা হয়েছিল তার। টুর্নামেন্ট শুরুতে অনেক বিশ্লেষকই বলেছিলেন, আইপিএলের ম্যাচ ফিক্সিং ইস্যু চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ধোনিদের পারফরম্যান্সের ওপর প্রভাব পড়বে। কিন্তু বাস্তবে হল তার উল্টো।
সেই ধোনিই এখন ভাসছেন সাফল্যের জোয়ারে। এবার যেন নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হল ভারতীয় ক্রিকেটের। নতুন একটা দল নিয়েই সাফল্য পেলেন ধোনি। ২০১১ সালের বিশ্বকাপ জয়ী দলের মাত্র তিনজন ক্রিকেটার ছিল তার দলে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতে ভারত উন্মোচন করলো এক নতুন দিনের। ইতিহাসে একমাত্র অধিনায়ক হিসেবে তিনটি ট্রফি ওঠল ধোনির হাতে। ২০০৯ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, এরপর বিশ্বকাপ এবং এই আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির শিরোপা জিতে গড়লেন বিরল এক রেকর্ড।
তাইতো যারা সমালোচনায় মুখর ছিলেন তাদেরই মুখে ধোনি বন্দনা। যেমনটা বলছিলেন ভারতীয় সাবেক অধিনায়ক, বিশ্লেষক সুনীল গাভাস্কার। তার কথা, ‘একদম ধ্বংসস্তূপ থেকে জয় ছিনিয়ে আনার দক্ষতা রয়েছে ধোনির। স্নায়ু চাপ সামলানোর যোগ্যতাটা দুর্দান্ত। ধোনি আসলে সফলতা এবং ব্যর্থতা দুটোকেই বরণ করার ক্ষমতা রাখে। আমার মনে হয় এটাই তাকে খাদের কিনারা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করে। ও সত্যিই অসাধারন।’
আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে শিরোপা জেতার জন্য ভারতীয় দলের প্রত্যেক ক্রিকেটারকে সে দেশের ক্রিকেট বোর্ড ১ কোটি রুপি পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। আর সহায়ক স্টাফদের প্রত্যেকে ৩০ লাখ রুপি করে পাবেন। এজবাস্টনের ফাইনালে বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে ২০ ওভারে কমিয়ে আনা হয় ম্যাচ। তাতে প্রথমে ব্যাট করে ৭ উইকেটে ১২৯ রানের মামুলি সংগ্রহ পেয়েছিল ভারত। জয়ের লক্ষ্যে নেমে ২০ ওভারে ৮ উইকেটে ১২৪ রানে থেমে যায় স্বাগতিক ইংল্যান্ড। শেষ তিন ওভারে জয়ের জন্য ২০ রান দরকার ছিল ইংল্যান্ডের। হাতে ৬ উইকেট। এ অবস্থা থেকেও ম্যাচ হারে অ্যালিস্টার কুকরা। এ জয়ে ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষস্থান আরও অটুট করল ভারত। এবং সেটা ধোনির অধীনেই।
ট্রফি হাতে নিয়ে ভারতের গর্বিত এ অধিনায়ক বলছিলেন, ‘তরুণ দল নিয়েই টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছিলাম। এবার একইরকম দল নিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতলাম। দলের বেশ ক’জন ক্রিকেটারেরই বেশি ওয়ানডে খেলার অভিজ্ঞতা নেই। ২০১১ বিশ্বকাপের পর আরও একটা অসাধারণ জয় পেলাম। আমি মনে করি তরুণরাই সব পরিস্থিতিকে পাল্টে দিতে পারে।’
এবার জেনে নিন মহেন্দ্র সিং ধোনির সাফল্যের সেই মুল মন্ত্র। আর সেটা তার জবানীতেই-
• দেখুন ট্যালেন্ট নয়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল দৃষ্টিভঙ্গি। চাপে পড়ে যাওয়ার পর যদি সেটা থেকে বের হওয়ার রাস্তা যদি জানতে পারেন তবে সেটাই ক্রিকেটের ক্রিকেটের রোমাঞ্চ।
• কে কতো বড় ক্রিকেটার। কার প্রোফাইল সমৃদ্ধ সেটা গুরুত্বপুর্ন নয়। ফিটনেস গুরুত্বপূর্ণ। তবে ফিট থাকার জন্য আপনাকে প্রতিদিন জিম যেতে হবে না। তবে ফিটনেস লুকানোটাও ভাল কথা নয়। লুকালে সেটা সবাই ঠিকই বুঝে নেবে। যেমনটা হয়েছিল শেবাগ আর যুবরাজের ক্ষেত্রে।
• ওয়ানডে দলে থাকতে হলে আপনার ফিল্ডিং ভাল হতেই হবে। তা না হলে রক্ষা নেই।
• কোচিং ম্যানুয়াল পড়ার দরকার নেই। টিম মিটিং, থিওরি সেসব কিছুও আমার দরকার নেই। মাঠে কাজ চাই। সাহস চাই। বক্তৃতা দিয়ে সময় নষ্ট করা চাই না।
• মিডিয়া কি দেখাল কিংবা কী লিখল মাথা ঘামাই না।। ওদের থেকে দুরে থাকাটাই ভালো।
• দেখুন, নিজেকে গুরুত্ব দেবেন। নিজে যেটা মনে করবেন সেটাই ঠিক মনে করে এগোবেন। কে কি বললো সেটা একটু পড়ে ভাবলেও চলবে। তাই বলে নির্বিকার হবে না।
• একটানা অনেক ম্যাচ খেলতে হতে পারে। অমানুষিক শারীরিক কষ্ট সহ্য করার জন্য সবসময় তৈরি থাকতে হবে।
• দলের ওপর কোনও রকম নাক গলানো যাবে না। সবাই তার মতো জায়গা পাবে। একইসঙ্গে মাঠে ভয় পেলে চলবে না। আর ফিল্ড সাজানোর সময় আমার দিকে চোখ রাখতে হবে।
এই হলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। কোন কিছুতেই একরত্তি ছাড় দিতে নারাজ। এজন্য কারো চুক্ষশুল হতেও দ্বিধা করেন না। কাছের বন্ধুদের কাছে তিনি মাহি নামেই পরিচিত। ২০১০ সালের ৪ জুলাই সাক্ষী রাওয়াতকে বিয়ে করেন ধোনি। কলকাতার মেয়ে সাক্ষী তাজ বেঙ্গল হোটেলে শিক্ষানবীশ হিসেবে কাজ শেখার সময় তারা একে-অপরের সঙ্গে পরিচয় হয়। বাগদানের একদিন পর খবরটা মিডিয়ার সামনে ফাস করেন তাদের পারিবারিক বন্ধু বলিউড অভিনেত্রী বিপাশা বসু। এখন অবশ্য ম্যাচ গড়াপেটার সঙ্গে তার স্ত্রীর নামটাও উঠছে।
সেই মহেন্দ্র সিং ধোনি ভারতের বিজ্ঞাপনের বাজারেও একচেটিয়া দাপট দেখাচ্ছেন। বিজ্ঞাপন বানিজ্যে বলিউড কিং শাহরুখ খানের পরই রয়েছেন তিনি। টেক্কা মেরেছেন বিগ বি অমিতাভ বচ্চনকেও। এ মুহূর্তে তিনি চুক্তিবদ্ধ পেপসি, রিবক, এক্সাইড, টিভিএস মোটরস, মাইসুর সোপ, ভিডিওকন, রিলায়েন্স কমিউনিকেশন, রিলায়েন্স এনার্জি, ওরিয়েন্ট পিএসপিও, ভারত পেট্রোলিয়াম, টাইটান সোনাটা, ব্রিলক্রিম, এনডিটিভি, জিই মানি, সিয়ারাম, বিগ বাজার, মাহা চোকো, বুস্ট, দৈনিক ভাস্কর, ডাবর হানি, কলকাতা ফ্যাশন উইক, এয়ারসেল, নোভা স্টটিয়া আর অমরাপল্লী কোম্পানির সঙ্গে। দু হাতে অর্থ কামাচ্ছেন ধোনি। আবার করও দিচ্ছেন দু’হাতে। এখন ভারতের সর্বোচ্চ করদাতাদের তালিকায় তিনিও একজন।
এখন অবশ্য সেই লম্বা চুল নেই। বলিউড অভিনেতা জন আব্রাহামের ভক্ত বলেই এক সময় লম্বা চুল রেখে নজর কেড়ে নিয়েছিলেন পাকিস্তানের একসময়ের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশারফফেরও। হয়ে ওঠেন ফ্যাশন আইকন।
বাইক ভালবাসেন তিনি। সময়-সুযোগ মিললেই মোটর সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন। রাঁচিতে তার গ্যারেজে রয়েছে ৪টি গাড়ি। সঙ্গে ২৩টি হাইস্পিড মোটর সাইকেল। গতির সঙ্গেই বসবাস ধোনির।
কিন্তু মাঠে একেবারেই ভিন্ন চেহারা। শান্ত, ধীর স্থীর! ক্যাপ্টেন কুল!
একনজরে-
পুরো নাম: মহেন্দ্র সিং ধোনি
জন্ম: ১৯৮১ সালের ৭ জুলাই
ব্যাটিং স্টাইল: ডানহাতি ব্যাটসম্যান
ফিল্ডিং পজিশন: উইকেটকিপার
ওয়ানডে অভিষেক: ২৩ ডিসেম্বর ২০০৪, প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ
টেস্ট অভিষেক: ২ ডিসেম্বর ২০০৫, প্রতিপক্ষ শ্রীলংকা
টেস্ট: ৭৭; রান: ৪২০৯; গড় ৩৯.৭০; ক্যাচ: ২১২
ওয়ানডে: ২২৪; রান ৭২৮৬; গড় ৫১.৩০; ক্যাচ ২১১
টি-টুয়েন্টি: ৪২; রান ৭৪৮; গড় ৩১.১৬; ক্যাচ ২১
Discussion about this post