গেল বছর ক্রিকেট মৌসুম শুরুর আগেই ‘ব্রেকিং নিউজ’-লুৎফর রহমান বাদল মোহামেডান ছেড়েছেন। কর্মকর্তা হিসেবে মোহামেডানের ক্রিকেটের সঙ্গে বাদল জড়িত ছিলেন প্রায় যুগেরও বেশি। ক্রিকেট ম্যানেজার ছিলেন। পরে ধাপ পেরিয়ে একসময় মোহামেডানের ক্রিকেট কমিটির সবচেয়ে বড় কর্তা চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন। মোহামেডান ক্লাবের লিমিটেড করা নিয়ে দ্বন্দ্ব ও ক্লাব পলিটিক্সের কাছে হেরে যান বাদল। তখনই সিদ্ধান্ত নেন-এ লড়াইয়ে হারের শোধ অন্যভাবে তুলে জিততে হবে তাকে। মোহামেডান ছেড়ে চলে আসেন ভিক্টোরিয়ায়। দলবদল শব্দটা সাধারণত খেলোয়াড়দের সঙ্গেই বেশি যায়। কিন্তু ক্লাবের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার এমনভাবে দলবদলের ঘটনা খুবই বিরল।
মোহামেডান ছেড়ে ভিক্টোরিয়া ক্রিকেট কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ার পরই বাদলের সঙ্গে চলে আসেন সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবাল। দেশসেরা এ দুই ক্রিকেটারও আগের মৌসুমে মোহামেডানে গিয়েছিলেন মূলত বাদলের যোগাযোগেই।
তবে এসব ক্ষেত্রে যা হয়; বাদলকে সেই ঝঞ্ঝা সইতে হয়। লড়তে হয় বিরুদ্ধ স্রোতে। মোহামেডান-আবাহনী কোন ইস্যুতে এক হয়েছে-এমন উদাহরণ দেশের ক্রীড়াঙ্গনে খুব একটা নেই। সেই ধারা ভেঙে এবারের ক্রিকেট মৌসুমে এ দুই ক্লাবও বাদলকে ‘কমন শত্রু’ জেনে কুঁদে নামে। ভিক্টোরিয়ায় খেলতে আসা পাকিস্তানি ক্রিকেটার মোহাম্মদ ইউসুফের ছাড়পত্র নিয়ে আপত্তি তোলে মোহামেডান। শেষমেশ তারই ধারাবাহিকতায় জটিলতায় পড়ে গত বছরের প্রিমিয়ার ক্রিকেট।
-ফলাফল?
প্রিমিয়ার ক্রিকেট ৬৩ দিন বন্ধ!
মোহাম্মদ ইউসুফের ছাড়পত্রের জটিলতা ও বিতর্ক ইস্যুটি ক্রমেই ‘বাদল ঠেকাও, ভিক্টোরিয়া আটকাও’তে রূপ নিল। ক্রিকেট কমিটি অব মেট্রোপলিশ ঢাকা (সিসিডিএম) পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হল। বিসিবির বোর্ডসভা পর্যন্ত গড়াল সেই বিচার। শুরুতে বিসিবিও সমাধান দিতে পারল না। শেষমেশ অনেক দেন-দরবারের পর সুপার লিগের ছয় ক্লাবের সমঝোতায় কোনোমতে ফের লিগ চালু হল।
মাঝখানে ক্রিকেটের ৬৪ দিন হারিয়ে গেল! তবে ভিক্টোরিয়াকে ওপরে উঠতে না দেওয়ার যে অঘোষিত লড়াই শুরু করেছিলেন মুখচেনা কিছু ক্রিকেট কর্তা-তারা শেষমেশ পরাজিতের দলে।
ওল্ড ডিওএইচএসকে ২ উইকেটে হারিয়ে সেই বছর প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগের শিরোপা জিতল ভিক্টোরিয়া। কিন্তু সত্যিকার অর্থে তো এই জয় লুৎফর রহমান বাদলের। চারধারের এত বাধা। এত বিপত্তি। এত প্রতিপক্ষ- কোনকিছুই তার সাফল্যে ঠেকাতে পারেনি।
বছর পরে এবারের ক্রিকেট মৌসুমের শুরুতে লুৎফর রহমান বাদল ভিক্টোরিয়া থেকে সরে দাড়ান। নিজের একটা ক্লাব গড়ায় হাত দেন। গাজী ট্যাংক ক্রিকেটার্সের মালিকানা স্বত্ব কিনে নেন তিনি। এই ক্লাবের নতুন নাম দেন-লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জ।
লক্ষ্য এবারও একটাই- ট্রফি চাই। চ্যাম্পিয়ন হতে হবে। সেই টার্গেট নিয়েই তারকা ক্রিকেটারদের নিয়ে দল গড়ার দিকে মনোযোগ দেন বাদল। জানা কথা-তামিম ও সাকিব বাদলের দলেই খেলবেন। আর এই দুই মহাতারকাকে নিয়ে দল গড়া মানেই বাদলের দলই সেরা দল। তাই সেরা দল গড়া থেকে বাদলকে ঠেকানো যায়- সেই ‘ষড়যন্ত্র’ শুরু হয়ে গেল। তারই অংশ হিসেবে ক্রিকেট কর্তারা দলবদলের বাজারে ছাড়লেন ‘প্লেয়ার বাই চয়েজ’-এর নতুন তত্ত্ব। এতে করে ঘরোয়া ক্রিকেটে তারকা ক্রিকেটারদের মুল্যমান কমে গেল। খেলোয়াড়রা নিজ পছন্দের দল বেছে নিতে পারলেন না। একবার জানান হল-ঘরোয়া ক্রিকেটে জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা খেলতে পারবেন না। কয়েকদিন পরে আবার সেই নিয়ম বদলে দিয়ে জানান হল-হ্যাঁ তারা খেলতে পারবেন। এতসব ঝুট ঝামেলার মধ্যে পড়ে ক্রিকেট লিগ পিছিয়ে গেল কয়েক মাস। বৃষ্টির মৌসুমে শুরু হল প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগ। লিগের প্রথম পর্যায় শেষে লুৎফর রহমান বাদলের গাজী ট্যাংক ক্রিকেটার্স পয়েন্টের শীর্ষে থেকে সুপার সিক্সে উঠে এল। সুপার সিক্সের শুরুটাও তাদের বেশ ভাল হল। মাঝে দুটো ম্যাচ হেরে খানিকটা হোঁচট খেল। তবে লিগ শিরোপা নির্ধারনের শেষ ম্যাচে প্রাইম দোলেশ্বরকে দাঁড়াতেই দিল না গাজী ট্যাংক ক্রিকেটার্স। ৬০ রানের বড় ব্যবধানে ম্যাচ জিতে প্রথমবারের মতো প্রিমিয়ার ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হল গাজী ট্যাংক ক্রিকেটার্স (লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জ)।
টানা দুই বছরই চারধারের নানাবিদ বাধা-বিপত্তির বিরুদ্ধে লড়ে লিগ শেষে শেষ হাসি হাসলেন লুৎফর রহমান বাদলই। সবমিলিয়ে ঢাকা প্রিমিয়ার ক্রিকেটে পেছনের চার বছরে তিনটি চ্যাম্পিয়ন ট্রফি জিতল তার দল। তাও আবার তিনবারই তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ক্লাবের হয়ে। তিনবারই তাকে এই লড়াইয়ে জেতার জন্য করতে হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন পরিকল্পনা। এবার তো কাজটা আরো বেশি কঠিন হয়ে পড়েছিল তার পরিচিত দুই ক্রিকেট শক্তি সাকিব ও তামিম দলে না থাকায়। কিন্তু স্থানীয় ও বিদেশিদের সঠিক কম্বিনেশনে গড়া তার দল সব প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে দিল। লিগ শুরুর আগে ফেবারিটের তালিকায় গাজী ট্যাংক ক্রিকেটার্সকে কেউ না রাখলেও মৌসুম শেষে সেই দলই সেরা!
দীর্ঘদিনের ক্রিকেট অভিজ্ঞতা, দক্ষতা গতিশীল পরিচালনা শক্তি এবং জেতার জেদ-ক্রিকেট সংগঠক হিসেবে লুৎফর রহমান বাদলকে উপহার দিল আরেকটি চ্যাম্পিয়ন ট্রফি।
যে জিততে জানে- কোন বাধাই তাকে হারাতে পারে না!
পেছনের চার মৌসুমে ক্রিকেট সংগঠক লুৎফর রহমান বাদলের সাফল্য
মৌসুম সাফল্য ক্লাব
২০০৯-১০ চ্যাম্পিয়ন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব
২০১০-১১ রানার্সআপ মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব
২০১১-১২ চ্যাম্পিয়ন ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব
২০১২-১৩ চ্যাম্পিয়ন গাজী ট্যাংক ক্রিকেটার্স (লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জ)
Discussion about this post