ঢাকা প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগে আম্পায়ারিং বিতর্ক নতুন কিছু নয়। গতবার এনিয়ে সরগরম হয়ে উঠেছিল ক্রিকেট পাড়া। এবার কি হবে? প্রশ্ন থাকছেই। এনিয়ে বুধবার একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ হল প্রথম আলো পত্রিকায়। পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হল-
গতবার প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগ পরিণত হয়েছিল ‘বিতর্ক লিগে’। রান-উইকেট ছাপিয়ে আলোচনার মূল বিষয় হয়ে উঠেছিল পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিং। এবারও কি তা-ই হবে? এই প্রশ্ন সামনে রেখেই বিকেএসপি ও ফতুল্লায় আজ শুরু হচ্ছে এবারের ঢাকা প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগ।
কাল দুপুরে লিগের স্পনসর ঘোষণার সংবাদ সম্মেলনও হয়ে গেল মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্যি, সংবাদ সম্মেলনের মঞ্চে ছিলেন না লিগ পরিচালনা কমিটি সিসিডিএমের কেউ! হয়তো ক্লাব ক্রিকেট নিয়ে অপ্রিয় প্রশ্নের ঝাঁজ সামলাতে পারবেন না বলেই তাঁদের এমন আড়ালে থাকা।
প্রসঙ্গটা তবু উঠল। আগামী দুই বছরের জন্য প্রিমিয়ার লিগের স্পনসর হয়েছে ওয়ালটন। এ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে একটু আবেগতাড়িত হয়ে পড়লেন ওয়ালটনের কর্মকর্তা উদয় হাকিম। ক্রিকেটের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির সম্পৃক্ততার কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে বলে ফেললেন, বিসিবি চাইলে ভবিষ্যতে ওয়ালটন প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেটের পৃষ্ঠপোষণায় আসতে পারে।
তাঁর কথার সূত্র ধরেই উঠল ওই আলোচনা, যেটি আসলে এখন ঢাকার ক্রিকেটজুড়েই বহমান। দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেটের সুপার লিগের খেলা চলছে। খেলা না বলে প্রহসন বলাই ভালো। বিসিবির প্রভাবশালী কিছু কর্মকর্তা ও তাঁদের সঙ্গীরা সম্পৃক্ত আছেন, এমন সাত-আটটি ক্লাবের প্রতি কয়েকজন আম্পায়ারের নির্লজ্জ পক্ষপাত, পাতানো ম্যাচ এবং নিগৃহীত দলগুলোর খেলোয়াড়দের ক্ষোভের উদ্গিরণ মিলে এবারের দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেট স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত লিগ। এসব জানার পর এমন লিগের সঙ্গে কোনো প্রতিষ্ঠান নিজেদের নাম জড়াতে চাইবে কি না সন্দেহ।
সর্বশেষ বিতর্কিত ঘটনাটি ঘটেছে গতকাল। সিটি ক্লাব মাঠে প্রথমে ব্যাট করে ৮৮ রানে অলআউট হয়ে যায় লালমাটিয়া। কিন্তু আম্পায়ারদের দেওয়া বেশ কিছু সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে অভিনব এক কাণ্ড করে বসে লালমাটিয়া। বোলার সুজন মাহমুদ ওয়াইড আর নোর বন্যা বইয়ে দেন। ফলে স্কোরকার্ডটা হয়েছে অদ্ভুত। যেটি দেখাচ্ছে, মাত্র চার বলেই ৯২ রান করে জিতে গেছে এক্সিওম ক্রিকেটার্স। কীভাবে তা সম্ভব? বৈধ বল হয়েছে ৪টিই। কিন্তু এর বাইরে সুজন ১৩টি ওয়াইড দিয়েছেন, যার প্রতিটিতেই আবার হয়েছে ৪টি করে ‘বাই’ রান। ‘নো’ বল করেছেন তিনটি। ওয়াইড থেকে এসেছে ৬৫ রান, ‘নো’ থেকে ১৫! এ ম্যাচে আম্পায়ার ছিলেন শামসুর রহমান ও আজিজুল বারী।
গত পরশু অভিনব প্রতিবাদের ঘটনা ঘটেছে এই দুই আম্পায়ারেরই আরেক ম্যাচে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে ‘পক্ষপাতমূলক’ আম্পায়ারিং মেনে নিতে না পেরে ওয়াইড-নোর বন্যা বইয়ে দিয়েছেন ফিয়ার ফাইটার্সের তাসনিম হাসান। ১.১ ওভারে রান দিয়েছেন ৬৯! শুধু ওয়াইড থেকেই ৪০, ‘নো’ বলে ১৫।
আরেক ঘটনা ঘটেছে ৪ এপ্রিল। অভিযোগ আছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে রেলিগেশন লিগের ম্যাচে নর্থ বেঙ্গল ক্রিকেট একাডেমির বিপক্ষে কাঁঠালবাগান গ্রিন ক্রিসেন্ট ক্লাবের সাত ব্যাটসম্যানকে এলবিডব্লু দিয়েছিলেন আম্পায়াররা। কিন্তু স্কোরকার্ডে এলবিডব্লু দেখানো হচ্ছিল চারজনকে। কাঁঠালবাগানের কর্মকর্তাদের প্রতিবাদের পর এলবিডব্লু হওয়া ব্যাটসম্যানের সংখ্যা ‘ছয়’ করা হয়। কিন্তু ম্যাচ শেষে চূড়ান্ত স্কোরকার্ডে দেখা যায় এলবিডব্লু পাঁচজন! স্কোরার হাবিব উল্লাহর অবশ্য দাবি, ‘ভুল-বোঝাবুঝি থেকে এটা হয়েছিল।’ ম্যাচে আম্পায়ার ছিলেন রফিকুল ইসলাম ও শাহীনূর রশিদ।
আম্পায়ারদের বিতর্কিত সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে ‘সৃষ্টিশীলতা’র ছাপও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। স্কোরকার্ডে নাকি সে কারণেই এলবিডব্লু আর কট বিহাইন্ড আউটের ছড়াছড়ি। এক ক্লাব কর্মকর্তা বলছিলেন, ‘এলবিডব্লু ভুল দিলে অনেক সময় বোঝা যায়। কিন্তু উইকেটের পেছনে ক্যাচ বোঝা যায় না। সে জন্য এখন আম্পায়াররা টেকনিক বদলেছে। এলবিডব্লুর পাশাপাশি এখন তারা প্রচুর কট বিহাইন্ডও দিচ্ছে। স্কোরকার্ড দেখে মনে হয়, দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেটে দেশের সেরা সেরা উইকেটকিপাররা খেলছে।’
বাজে আম্পায়ারিংয়ের প্রতিবাদ করে আম্পায়ারদের দুর্বলতার আর মাস্তানদের চোখ রাঙানির মধ্যে পড়তে হয়েছে নারায়ণগঞ্জ ক্রিকেট একাডেমির কোচ ও জাতীয় দলের সাবেক ওপেনার জাহাঙ্গীর আলমকে। এর আগে প্রথম বিভাগ ক্রিকেটেও ঘটেছে এ রকম অনেক ঘটনা। এর একটির ভিডিও ফুটেজ তো ইউটিউবেও আছে!
গত ১১ ফেব্রুয়ারির ওই ম্যাচের ফুটেজে দেখা যায়, বিকেএসপিতে ম্যাচ রেফারি বেলায়েত হোসেনের সামনেই রূপগঞ্জ টাইগার্সের খেলোয়াড়দের প্রথমে ধমকাধমকি ও পরে গালিগালাজ করছেন শাইনপুকুরের কোচ ও বিসিবির পরিচালক খালেদ মাহমুদ। খেলোয়াড়দের লাত্থি মেরে মাঠ থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে তিনি বলেন, ‘শাইনপুকুর কার টিম জানস?’ কাল মুঠোফোনে ম্যাচ রেফারি বেলায়েত হোসেনের কাছে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি প্রথমে জানান, ‘দ্যাট ওয়াজ রিপোর্টেড।’ পরে আবার নিজেই ফোন করে বললেন, খালেদ মাহমুদ খেলোয়াড়দের ধমকাধমকি করেছেন, এ রকম কিছু নাকি তিনি দেখেননি।
প্রিমিয়ার লিগের বাতাবরণে পুরোনো শঙ্কাটা তাই থাকছেই—আম্পায়ারিং নিয়ে বিতর্ক এবারও পিছু নেবে না তো!
সিসিডিএম চেয়ারম্যানও অসহায়!
আম্পায়ারিং বিতর্কের সমাধান তাহলে সিসিডিএম চেয়ারম্যানের কাছেও নেই! দ্বিতীয় বিভাগ লিগের পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিং নিয়ে জানতে চাইলে কাল মুঠোফোনে এমন অসহায়ত্বই প্রকাশ করেছেন সিসিডিএম চেয়ারম্যান ও বিসিবি পরিচালক গাজী গোলাম মোর্তজা।
সমস্যা সমাধানের একটা পথই দেখেন সিসিডিএম প্রধান, ‘সমাধান একমাত্র তখনই সম্ভব হবে, যখন লিগ চলার সময় আম্পায়ারদের দায়িত্ব সিসিডিএম পাবে। আমার আরেকটা প্রস্তাব ছিল, প্রতিটি ক্লাব আম্পায়ারদের নাম দেবে। নতুন কিছু আম্পায়ার আছেন, তাঁদের নামও আমরা নেব। খেলার আগের দিন আমরা দুই ক্লাবের প্রতিনিধির সামনে লটারি করব। লটারিতে যে দুজন আম্পায়ারের নাম আসবে, তাদের মাঠে পাঠাব। কিন্তু সেটাও করতে পারিনি।’
আম্পায়ারিং বিতর্কের দায়ভার সিসিডিএম নেবে না বলেও জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। তাঁর অভিযোগ, ‘বারবার বলার পরও আম্পায়ার্স কমিটির কাছ থেকে কোনো সাড়া পাইনি। তাদের অনেকবার অনুরোধ করেও কোনো লাভ হয়নি। তারা বলে, ম্যাচের আম্পায়ার মনোনয়ন করা তাদের এখতিয়ার। এভাবে কোনো দিনই সমস্যার সমাধান হবে না। লিগে কোন ম্যাচে কে আম্পায়ারিং করবে, সেটি ঠিক করার দায়িত্ব সিসিডিএমকেই দিতে হবে।’
প্রথম বিভাগ ক্রিকেটে রূপগঞ্জ টাইগার্সের খেলোয়াড়দের সঙ্গে শাইনপুকুর ক্রিকেট ক্লাবের কোচ খালেদ মাহমুদের অসদাচরণের ব্যাপারে জানতে চাইলেও ফুটে উঠল সিসিডিএম চেয়ারম্যানের অসহায়ত্ব। বিষয়টি নিয়ে কোনো মন্তব্য করতেই রাজি হলেন না তিনি।
Discussion about this post