সময়টা আশির দশকের মাঝামাঝি। বিশ্বসুন্দরীরা কে কেমন বর পছন্দ করেন-সেই গল্পের মাঝে হঠাত্ করে মিস অস্ট্রেলিয়ার কাছে একটা প্রশ্ন উড়ে গেল-‘তা আপনি এবারের ক্রিসমাসে কী উপহার পেলে সবচেয়ে বেশি খুশি হবেন।’
বেশি সময় না নিয়ে মিস অস্ট্রেলিয়া বললেন-‘ইমরান খান’!
ব্যস, সেই তখন থেকে ক্রিকেট আড্ডায় ‘হ্যান্ডসাম বিষয়ক গল্পে’ এটা খুব জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত উক্তি হয়ে গেল।
ইমরান খান। নামের মধ্যেই একটা জাদুকরী আকর্ষণ! খেলার মাঠে। মাঠের বাইরে। চলাফেরায়। কথাবার্তায়। হাসিতে। ব্যাটে-বলে। ব্যক্তিত্বের ছটায়-তার সবকিছুতেই দুর্বিনীত এক আকর্ষণ!
একটু অন্যভাবে বলি-ক্রিকেটে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা হয়ে হাঁটছেন ইমরান। আর তার পেছনে দৌড়াচ্ছে বিশ্বের তাবত্ সুন্দরীরা!
আহা যদি একবার তাকে ছোঁয়া যায়!
এই দৌড়ে জানাশোনা প্রতিদ্বন্দ্বীদের নামগুলো একটু শুনি। কলকাতায় মুনমুন সেন। বোম্বেতে জিনাত আমান। আমেরিকায় সিতা হোয়াইট। ইংল্যান্ডে সুসানাহ কনস্টানটাইন, লেডি ক্যাম্পবেল, চিত্রশিল্পী এমা সার্জেন্ট।
ভাবছেন ব্যস এটুকুই! মূলত ইমরানের জীবনে প্রেমের সংখ্যা এত বেশি যে, কোনোটাই বেশি লম্বা হয়নি। একজন গেছেন। সঙ্গে সঙ্গে অন্যজন হাজির। কে প্রথম আর কে মাঝেরজন-সম্ভবত সেই নামটাও ভুলে গেছেন ইমরান!
আমরা তাই মনে রাখি কী করে! এমনসব ক্ষেত্রে সাধারণত যা হয়-ইমরান খানও সেই পথেই হাঁটা শুরু করলেন। ত্রিশ পেরিয়ে গেল। কিন্তু বিয়ের কথা মুখেই আনছেন না। পয়ত্রিশও হয়ে গেল। তারপরও বিয়ের প্রসঙ্গ উঠলেই জবাব কেবল রহস্য ছড়ানো-মুচকি হাসি!
কারও আশা না ভেঙে সবাইকে আশায় রাখা-রাসপুতিনীয় প্রেমের এ সূত্র ঠিক রেখে চল্লিশের পরও নিজেকে ‘মোস্ট এলিজেবল ব্যাচেলর’-এর তালিকায় রাখেন ইমরান। অবশেষে একসময় সেই ইনিংসও শেষ হয় তার।
বিশ্বের সব গোলার্ধে তরুণী হূদয়ে ঝড় তোলা ইমরান বউ হিসেবে বেছে নেন ব্রিটিশ ধনকুবেরের মেয়ে জেমিমা গোল্ডস্মিথকে।
প্রথম যৌবন ইংল্যান্ডে কাটানো। অক্সফোর্ডে পড়াশোনা। কাউন্টিতে খেলা-সব কিছু মিলিয়ে ইংল্যান্ড ছিল ইমরানের সেকেন্ড হোম। বিয়ের জন্যও সঙ্গী বেছে নিলেন তিনি সেখান থেকে। বিয়ের আগে জেমিমা গোল্ডস্মিথকে তেমন করে কেউ চিনত না। ধনকুবের বাবার নামেই তিনি বিখ্যাত ছিলেন। ব্রিটেনের অন্যতম ধনীদের একজন ছিলেন জেমিমার বাবা। ধারণা করা হচ্ছে, ইমরানের প্রেমে তার আকর্ষণে একপ্রকার অন্ধ হয়েই জেমিমা সব ছেড়ে ছুড়ে তাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। বিয়ের সময় ইমরানের বয়স ছিল ৪২। কনে জেমিমার ২১।
বিয়ের আগে ইমরানের দেওয়া সব শর্তই কবুল করেন জেমিমা। ইহুদি ধর্ম ছেড়ে মুসলমান হন। মুসলিম নাম হয় তার হাইকা। ১৯৯৫ সালের ১৬ মে রিচমন্ডে পুরোদস্তুর ইসলামি কায়দায় ইমরান ও জেমিমার বিয়ে হয়। বিয়ের পর জেমিমা পাকিস্তানে চলে আসেন। অপরিচিত পাকিস্তানি সংস্কৃতি ও বোলচালের সঙ্গে মানিয়ে নিতে নিজেকে পুরোপুরি পাল্টে ফেলেন জেমিমা। পাশ্চাত্যের পোশাক ও চালচলনে অভ্যস্ত জেমিমা সালোয়ার-কামিজ পরা শুরু করেন। মাথা ঢাকেন ওড়নায়। ইসলামের অনুশাসন মেনে চলতে শুরু করেন। এমনকি উর্দুও শেখেন।
এরই মধ্যে ইমরান খান পাকিস্তানে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারও শুরু করেন। ইমরানের রাজনৈতিক মিছিলে ওড়না মাথায় জেমিমাকেও দেখা যেতে লাগল। দারুণ সুখে ভরা তাদের সংসারে দুই শিশুপুত্র জন্ম নিল-সুলেইমান ও কাশিম।
বিয়ের পরও ইংল্যান্ডের যান জেমিমা। তবে বছরের বেশিরভাগ সময় তার কাটে পাকিস্তানে। ইমরান খান এ সময় রাজনীতিতে বেশি ব্যস্ত হয়ে যান। তেহরিকে ইনসাফ নামের একটি রাজনৈতিক দলও গড়ে তোলেন তিনি। পাকিস্তানের পার্লামেন্টে নির্বাচিতও হন ইমরান। কিন্তু তার রাজনৈতিক দল তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। পাকিস্তানের সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের রোষানলে পড়ে মিথ্যে মামলার জেরে ইমরানকে একসময় জেলেও যেতে হয়। সে সময় প্রায় বছরখানেক জেমিমা তার ও সন্তানদের নিরাপত্তায় ইংল্যান্ড চলে যান। ইমরান জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ফেরেন। কিন্তু সেই তখন থেকেই এ জুটির মধ্যে ভাঙনের সুর শোনা যেতে লাগল।
পূর্ব ও পশ্চিমের সাংস্কৃতিক বিরোধ। দ্বন্দ্ব-জীবনবোধ হঠাত্ করে তাদের দাম্পত্য জীবনে ছন্দপতন ঘটায়।
-সংসারজীবন নাকি রাজনীতি?
এ দুইয়ের মধ্যে একটা পছন্দ বেছে নেওয়ার সময় এসে দাঁড়ায় ইমরানের সামনে। যখন মাঠে ক্রিকেট খেলতেন তখনও এমন অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত তাকে নিতে হয়েছে। শেষমেশ রাজনীতিকে বেছে নিলেন ইমরান। বউ বাদ। বিয়ে করার জন্য জেমিমাও যেভাবে পাগলপারা হয়েছিলেন; ডিভোর্সের জন্যও ঠিক তেমনই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন। ইমরান-জেমিমা জুটির নবম বিবাহবার্ষিকীটা কাটল ডিভোর্সের ফাইল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে! অবশেষে ২০০৪ সালের ২২ জুন-আনুষ্ঠানিকভাবে ডিভোর্স সম্পন্ন হল। ইমরান ‘পরাজয়’ মেনে নিয়ে জানালেন-‘জেমিমা পাকিস্তানে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার সব চেষ্টাই করেছে। কিন্তু আমার রাজনৈতিক জীবনের জন্য তার এখানে টিকে থাকাটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাই আমরা সমঝোতার মাধ্যমে এ ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটা আমাদের দুজনের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক একটা অধ্যায়। ঘটনা। আমার বাসা এবং ভবিষ্যত্ পাকিস্তানেই।’
-তো কী বুঝলেন?
কেবল নিজের রাজনৈতিক জীবনকে সফল করতে ইমরান বউকে ছেড়ে দেওয়ার এ সিদ্ধান্ত নিলেন!
কোনো সন্দেহ নেই এ আলোচিত ডিভোর্সের সিংহভাগ দায়ভার ইমরানের ঘাড়েই যাচ্ছে। একটা মেয়ে নিজের ধর্ম, পরিবার, ঐতিহ্য, পাশ্চাত্যের চাকচিক্য ছেড়ে এমনকি নিজের নামও বদলে সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা দেশে চলে এল-কিন্তু থাকতে পারল না। নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে সফেদ করতেই ইমরান এ ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেন বলে পাকিস্তানের বিশ্লেষকদের বিশ্বাস।
জেমিমাকে শুরু থেকেই পাকিস্তানের জনগণ বিশ্বাস করতে পারেনি। তার বিয়ে এবং ইমরানের হঠাত্ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া-এ দুইয়ের মধ্যে পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিমাদের একটা ষড়যন্ত্র খুঁজে পায়। পাকিস্তানজুড়ে প্রচলিত একটা ধারণা ছড়িয়ে পড়ে, ইহুদি ধর্মের মেয়েকে ইমরানের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে আমেরিকা পাকিস্তানে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে। আর এ কাজে ইমরানকে স্রেফ ঘুঁটির মতো ব্যবহার করছে পশ্চিমা বিশ্ব। মূলত এ ধারণা একসময় পাকিস্তানের জনগণের কাছে জনপ্রিয় বিশ্বাসে পরিণত হয়। সেজন্যই ইমরানের তেহরিকে ইনসাফ পাকিস্তানে মোটেও জনপ্রিয়তা পায়নি। এ দলটি পশ্চিমাদের দালাল-এ ব্র্যাকেটেই আটকে যায়। ইমরানের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের নিশ্চিত অপমৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়।
সেই মৃত্যু ঠেকাতেই ইমরান-জেমিমার ডিভোর্স!
ক্রিকেট মাঠে অধিনায়ক হিসেবে ইমরানকে কখনও এত নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত নিতে হয়নি।
কী করবেন-রাজনীতির বেশিভাগ অংশজুড়েই যে শঠতা-নিষ্ঠুরতা!
Discussion about this post