ঢাকা টেস্টের একাদশ থেকে মোসাদ্দেক হোসেন বাদ পড়ায় প্রশ্ন উঠেছে যথেষ্টই। জাতীয় দলে একজন খেলোয়াড়ের স্থানকে ‘মিউজিক্যাল চেয়ার’ বানিয়ে তোলায় নির্বাচকেরা সমালোচনার মুখে তো পড়েছেনই, নতুন করে প্রশ্ন উঠছে, মোসাদ্দেকের বাদ পড়ায় ক্লাব-স্বার্থ জাতীয় স্বার্থকে ছাপিয়ে যাচ্ছে কিনা!
শুক্রবার দল থেকে বাদ পড়েই মোসাদ্দেক আবাহনী লিমিটেডের হয়ে ঢাকা প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগে মাঠে নেমেছেন। কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের হয়ে খেলেছেন ৪০ রানের এক ইনিংস। চট্টগ্রাম টেস্টের প্রথম ইনিংসে খুব বাজে শট খেলে আউট হলেও দ্বিতীয় ইনিংসে ৫৩ বলে ৮ রান করে টেস্টটি ড্র করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা কিন্তু তাঁর ছিল। ঢাকা টেস্টে বাংলাদেশের উইকেট পতনের মিছিলের মধ্যে যখন নিচের দিকে প্রতিরোধ প্রয়োজন ছিল, তখন মোসাদ্দেককে কিন্তু ঠিকই মিস করেছে বাংলাদেশ দল।
জাতীয় দলের স্কোয়াড থেকে বাদ পড়ার পরপরই প্রিমিয়ার লিগে নিজ নিজ ক্লাবের হয়ে খেলোয়াড়েরা খেলতেই পারেন। কিন্তু মোসাদ্দেকের বাদ পড়াটা চোখ রাঙাচ্ছে। কারণ, বাংলাদেশের টেস্ট স্কোয়াডে একজন গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেটার হিসেবেই তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। গত মার্চে শততম টেস্টে লঙ্কানদের বিপক্ষে জয়ে মোসাদ্দেকের ভূমিকা ছিল দুর্দান্ত। প্রথম ইনিংসে ৭৫ রানের এক ইনিংস খেলেছিলেন, সেঞ্চুরিয়ান সাকিব আল হাসানের সঙ্গে বড় জুটি গড়ে বাংলাদেশ লিড নিতে সহায়তা করেছিলেন। দ্বিতীয় ইনিংসেও কঠিন পরিস্থিতিতে মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে ছোট মহাগুরুত্বপূর্ণ এক জুটিতে দলের জয়ের ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। এরপর চোখের সমস্যায় জাতীয় দল থেকে বাদ পড়লেও সুস্থ হওয়ার পর তাঁর জায়গাটা তো নিশ্চিতই থাকার কথা। সমালোচনাটা আরও বড় হচ্ছে, কারণ ঢাকা টেস্টে মোসাদ্দেকের জায়গায় ফেরানো হয়েছে সাব্বির রহমানকে, টেস্টে যাঁর ব্যাটিং-সামর্থ্যই প্রশ্নবিদ্ধ।
চট্টগ্রামে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম টেস্টে স্কোয়াডে জায়গা পেয়েও একাদশে সুযোগ পাননি আবদুর রাজ্জাক। সুযোগ পাননি অনূর্ধ্ব-১৯ দলের তরুণ স্পিনার নাঈম হাসানও। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরে প্রিমিয়ার লিগের শুরুর ম্যাচে নিজ নিজ ক্লাবের হয়ে খেলেছেন। রাজ্জাককে ফেরানো হয়েছে ঢাকা টেস্টের একাদশে। এসব নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। কিন্তু মোসাদ্দেকের বাদ পড়া ও নিজের ক্লাবের হয়ে খেলাটা কিন্তু সবাইকে নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে।
প্রশ্নটা আরও বেশি করে উঠছে, বিসিবির শীর্ষ কর্মকর্তাদের পরিচয় বিচার করেই। তাঁদের অনেকেই দেশের সবচেয়ে সফল ক্লাব আবাহনীর সঙ্গে দীর্ঘ দিন ধরে সংশ্লিষ্ট। এ ছাড়া আবাহনীর হেড কোচ খালেদ মাহমুদ সুজনও যেখানে দায়িত্ব পালন করছেন জাতীয় দলের টিম ডিরেক্টর হিসেবে।
ক্রিকেট ওয়েবসাইট ইএসপিএন-ক্রিকইনফোও ব্যাপারটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তাদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয় দলের স্কোয়াড থেকে ক্লাবের হয়ে খেলোয়াড় ছাড়ার নজির থাকলেও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের জন্য কখনোই খেলোয়াড় ছাড়া হয় না। গত মাসের ত্রিদেশীয় সিরিজে একাদশ থেকে বাদ দিলেও খেলোয়াড়দের স্কোয়াডের সঙ্গেই রেখে দেওয়া হয়েছিল, বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগে (বিসিএল) বড় দৈর্ঘ্যের ম্যাচের জন্য তাঁদের ছাড়া হয়নি।
ক্রিকইনফো এ ব্যাপারে ২০১৪ সালেরও একটা উদাহরণ তুলে ধরেছে। সেবার জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজের সময় বেশে কয়েকজন খেলোয়াড়কে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ব্যবহার করা হয়েছিল, যেন তাঁরা নিজেদের ক্লাবের হয়ে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে খেলতে পারেন। ২০১২ সালে ইংল্যান্ড ‘লায়ন্সে’র বিপক্ষে বাংলাদেশ ‘এ’ দলের সিরিজে ৩০ জন ক্রিকেটার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে খেলানোর উদাহরণও টানা হয়েছে ক্রিকইনফোর প্রতিবেদনে। তাদের মতে, এ ধরনের উদাহরণ কখনোই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের ক্ষেত্রে তৈরি হয়নি।
ক্লাবগুলোর প্রতি এ দেশের ক্রিকেটের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। সত্তর-আশি ও নব্বইয়ের দশকে ক্রিকেটকে হাত ধরে সামনে এগিয়ে নিয়েছে এই ক্লাবগুলোই। আবাহনী-মোহামেডান-বিমান (এখন নেই), ব্রাদার্স, কলাবাগানের মতো ক্লাবের পৃষ্ঠপোষকতার অনেক অবদান বাংলাদেশের ক্রিকেটের অগ্রযাত্রায়। কিন্তু এই ক্লাবগুলো কখনো কখনো প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেছে বিভিন্ন বিষয়ে, যা ক্ষতির কারণ হয়েছে। টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পরেও ক্লাব সংস্কৃতির কোনো বদল হয়নি। মোসাদ্দেকের বাদ পড়া যদি সে সংস্কৃতিরই অংশ হয়, সেটা কিন্তু এ দেশের ক্রিকেটের জন্য ভবিষ্যতে বড় সমস্যারই সৃষ্টি করতে পারে।
–(লেখাটি দৈনিক প্রথম আলো অনলাইনে ১০ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয়েছে।। পাঠক আগ্রহের কথা ভেবে এটি ক্রিকবিডি২৪.কমের ব্লগে তুলে রাখা হল)।
Discussion about this post