সদ্যসমাপ্ত টি-২০ বিশ্বকাপ ক্রিকেট নিয়ে ১৬০ পৃষ্ঠার রিপোর্ট তৈরি করেছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) অ্যান্টি করাপশন অ্যান্ড সিকিউরিটি ইউনিট (আকসু)। এই বিশ্বকাপে অর্থ লোপাট ও দুর্নীতির নতুন রেকর্ড হয়েছে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে কয়েক কোটি টাকা। আর এই কাজে জড়িত খোদ বিসিবির পরিচালকরা।
দুর্নীতির বড় খাত হসপিটালিটি ও কর্পোরেট বক্স বিক্রি। পনেরটি হসপিটালিটি বক্সের মধ্যে কয়টি বিক্রি হয়েছে তা জানে না বিসিবির সংশ্লিষ্ট বিভাগ। ২২টি কর্পোরেট বক্সের মধ্যে বিক্রি হয়নি পাঁচটি। হসপিটালিটি বক্সের টিকিট বিক্রির দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল সরকার ট্রেড লিংক কোম্পানিকে। বক্স বিক্রির টাকার পাঁচ ভাগ কমিশন বাবদ এই কোম্পানি পাবে প্রায় এক কোটি ৬০ লাখ টাকা। অন্যদিকে কর্পোরেট বক্স বিক্রির দায়িত্ব পেয়েছিল মিয়া অ্যান্ড অ্যসোসিয়েটস। তাদের পাওনা ৫৪ লাখ টাকা। এই দুই কোম্পানির নেপথ্যে রয়েছেন বিসিবির তিন পরিচালক। অভিযোগ উঠেছে, একটি বড় মোবাইল কোম্পানি করর্পোরেট বক্স কিনেছে ৮০ লাখ টাকা দিয়ে। কিন্তু বিসিবির এক পরিচালক ওই কোম্পানির কাছ থেকে অতিরিক্ত ২০ লাখ টাকা নিয়েছেন। ওই পরিচালক মোবাইল কোম্পানিকে হুমকি দিয়েছিলেন এই বলে যে, তাকে ২০ লাখ টাকা না দিলে বক্স পাওয়া যাবে না। এখানেই শেষ নয়। যেসব বক্স অবিক্রীত দেখানো হয়েছে, সেগুলোতে প্রতিদিনই অবৈধ পাসের মাধ্যমে লোক বসানো হয়। বিনিময়ে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে বড় অংকের অর্থ। কর্পোরেট বক্সগুলোতে ভলান্টিয়ার ছেলে-মেয়েদের জন্য আইসিসি তিন হাজার টাকা করে বরাদ্দ দিলেও ভলান্টিয়াররা পেয়েছেন মাত্র পাঁচশ টাকা করে।
টিকিট নিয়ে দুর্নীতির অজস্র চিত্র উঠে এসেছে। সেলিব্রেটি কনসার্টের ব্যানারে লুটে নেয়া হয়েছে কয়েক কোটি টাকা। এখানেও ওই তিন পরিচালকের কারসাজি ছিল। কনসার্টের দিন মাঠের মধ্যে চার হাজার দর্শক থাকার কথা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে মাঠে ছিল প্রায় আট হাজার দর্শক। শোনা যায়, ওই পরিচালকরা বিশেষ পাসের মাধ্যমে লোক ঢুকিয়েছেন। বিনিময়ে নিয়েছেন টিকিটের মূল্য। এ তো গেল শুধু টিকিটের খাত। টি ২০ বিশ্বকাপে লুটপাট হয়েছে সর্বত্র। কক্সবাজার স্টেডিয়ামে ঘাস লাগানোর ক্ষেত্রে আড়াই টাকার ঘাসের দাম নয় টাকা নেয়া হয়েছে। তড়িঘড়ি করে বিনা টেন্ডারে কাজ করে লুটে নেয়া হয়েছে কয়েক কোটি টাকা। চট্টগ্রাম জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে কয়েক দফা বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে নিুমানের জেনারেটরের কারণে। এই জেনারেটর বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত বিসিবির এক পরিচালক এবং ওই পরিচালকের ভায়রা ভাই। বিশ্বকাপ ভেন্যুতে জেনারেটর সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের নাম অমনি পাওয়ার। জেনারেটর বাণিজ্যের নেপথ্যে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। জানা গেছে, চট্টগ্রামে ১৬টি ম্যাচে নিরবছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্যে জেনারেটর কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান করেছিল বিসিবি। দেশের বেশিরভাগ স্টেডিয়ামে শক্তিশালী ও উন্নতমানের জেনারেটর সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাক্যাট পাওয়ার এই দরপত্রে অংশ নিয়ে জেনারেটর সরবরাহের অর্ডার পায়। কিন্তু নানা নাটকের পর এ কাজ চলে যায় বিসিবির প্রভাবশালী কর্তার মালিকানাধীন অমনি পাওয়ার-এর কব্জায়।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, আকসু টি ২০ বিশ্বকাপ নিয়ে ১৬০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন তৈরি করেছে। ওই প্রতিবেদনে টি ২০-কে ঘিরে যেসব অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল, তা লিপিবদ্ধ রয়েছে। সূত্র জানায়, আকসু সহসাই রিপোর্ট আইসিসির কাছে জমা দেবে। ওই রিপোর্ট প্রকাশিত হলে বেরিয়ে পড়বে দুর্নীতিবাজ অনেক রাঘব-বোয়ালের নাম।
কনসার্টের নামে কয়েক কোটি টাকা লোপাট
টি ২০ বিশ্বকাপের টিকিট বিক্রির খাতেই প্রায় ১০ কোটি টাকার মুনাফা অন্যের হাতে তুলে দিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। সেলিব্রেশন কনসার্টের নামে পরিচালক সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিয়েছে সাত কোটি টাকা। টুর্নামেন্ট উপলক্ষে ভেন্যু সংস্কারের কাজের জন্য বিসিবির তহবিল থেকে প্রায় ৬৪ কোটি টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। যার শতকরা ১০ ভাগ কমিশন হাতিয়ে নিয়েছেন এক পরিচালক। সেলিব্রেশন কনসার্টের নামে কয়েক কোটি টাকা লোপাটের চাঞ্চল্যকর তথ্য রয়েছে। এই কনসার্ট আয়োজনে গ্রে নামে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। কথা ছিল, গ্রে কলাকুশলীদের সম্মানীসহ যাবতীয় খরচ বহন করবে। সেই সঙ্গে কনসার্টের টিকিট বিক্রির টাকাও পাবে গ্রে। কনসার্টের কাজ দেয়ার জন্য বিসিবির কয়েকজন পরিচালকের সমন্বয়ে গড়া সিন্ডিকেট প্রায় সাত কোটি টাকা নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ভারতীয় সঙ্গীত শিল্পী এআর রেহমানের পেছনে খরচ হয়েছে সাত কোটি টাকা। অথচ মিডিয়ার কাছে বলা হয়েছিল, ১৯ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে এআর রেহমানকে। অর্থ মন্ত্রণালয় বিভিন্ন পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিয়ে কনসার্ট আয়োজনে বিসিবিকে অর্থ দিয়েছে। অথচ টি ২০ বিশ্বকাপের সঙ্গে কনসার্টের কোনো সম্পর্ক ছিল না। যার প্রমাণ পাওয়া যায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) ইভেন্ট ডিরেক্টর টেটলির পাঠানো ই-মেইল থেকে। টেটলি হোস্ট টুর্নামেন্ট ডিরেক্টর তানভির কামরুল ইসলামসহ টুর্নামেন্টের সঙ্গে জড়িত আইসিসির নিয়ন্ত্রণাধীন প্রত্যেককে ই-মেইলে জানিয়েছেন, কেউ যেন বিসিবির সেলিব্রেশন কনসার্টে না যান। এ সিদ্ধান্তের ব্যত্যয় হলে তাদের চাকরিচ্যুত করারও হুমকি দেয়া হয়েছিল ওই ই-মেইলে।
মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামের পুরনো আইসিসি বক্স সংস্কারের দায়িত্ব দেয়া হয় বেক্সিকোকে। এজন্য একটি অসম চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল বিসিবি ও বেক্সিকোর মধ্যে। চুক্তি অনুযায়ী, পুরনো আইসিসি বক্সটি বেক্সিমকো নিজেদের অর্থায়নে সংস্কার করবে। বিনিময়ে পাঁচ বছর বক্সের মোট আসনের অর্ধেক টিকিট পাবে বেক্সিকো। জানা গেছে, প্রায় তিন কোটি টাকা খরচ করে বক্সটি সংস্কার করেছে বেক্সিমকো। কিন্তু এক টি ২০ বিশ্বকাপ ক্রিকেটেই প্রায় দ্বিগুণ অর্থ মুনাফা করেছে কোম্পানিটি। অথচ, এই টুর্নামেন্টের জন্য বিসিবি নিজেদের তহবিল থেকে প্রায় ৬৪ কোটি টাকা নাকি খরচ করেছে। যদি তাই হবে, তাহলে বিসিবি তিন কোটি টাকা খরচ করে পুরনো আইসিসি বক্স সংস্কার করল না কার স্বার্থে? বিসিবি সংস্কার করলে টিকিট বিক্রির পুরো টাকাটাই বোর্ডের তহবিলে জমা হতো। বিসিবির এক পরিচালক জানান, “বিসিবির নির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টে বোর্ডের কেউ জড়িত হতে পারবেন না। কিন্তু এক্ষেত্রে তার ব্যত্যয় হয়েছে।” বিসিবির সভাপতি নাজমুল হাসান বেক্সিকো গ্র“পের পরিচালক। কাজেই এটা টার্মস অ্যান্ড রেফারেন্সের সুস্পষ্ট লংঘন।
টুর্নামেন্ট উপলক্ষে বিভিন্ন স্টেডিয়াম ও ভেন্যু সংস্কারের জন্য বিসিবির তহবিল থেকে প্রায় ৬৪ কোটি টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। গত ৩ মার্চ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কাছে বিসিবির ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিজামউদ্দিন চৌধুরী সুজনের লেখা পত্রে (সূত্র নং-বিসিবি/প্রশাসন/২০১৪/২৫৪) ৬৪ কোটি টাকা ব্যয়ের কথা বলা হয়েছে। ওইসব কাজের জন্য কোনো টেন্ডার আহ্বান করেনি বিসিবি। বিসিবির এক পরিচালক (যিনি মতিঝিলের একটি ঐতিহ্যবাহী ক্লাবের বড় কর্মকর্তা) নেপথ্যে থেকে ওইসব সংস্কার কাজ নিজেই তদারকি করেছেন। শোনা যায়, শতকরা ১০ ভাগ কমিশন হাতিয়ে নিয়েছেন ওই পরিচালক। এ প্রসঙ্গে বিসিবির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যতই দিন যাচ্ছে, বিসিবিতে দুর্নীতির ডালপালা আরও বিস্মৃত হচ্ছে। সরকারের কাছে আমার অনুরোধ থাকবে, বিসিবির মধ্যে গড়ে ওঠা এই সব দুর্নীতির তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা যেন নেয়া হয়। তা না হলে ক্রিকেট সহসাই অন্ধকারে হারিয়ে যেতে পারে।
৬৪ কোটি টাকা খরচ দেখানোর হিসাব
স্টেডিয়াম/ভেন্যুখরচ
মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়াম৯,২৪,৩২,০০০ টাকা
(দুটি ড্রেসিংরুম ও হসপিটালিটি বক্স)
ফতুল্লা আউটার স্টেডিয়াম৬,১৮,৩৬,৪৫৪ টাকা
সাভার বিকেএসপি১৬,৩০,১৫,২১৬ টাকা
কক্সবাজার শেখ কামাল স্টেডিয়াম২৭,৫১,৯২,২৪৭ টাকা
সিলেট জেলা স্টেডিয়াম ১,৪৪,৭০,৩০০ টাকা
চট্টগ্রাম জহুর আহমেদ স্টেডিয়াম ১,২৩,২৩,৬১০ টাকা
অন্যান্য ভেন্যু২,০০,০০,০০০ টাকা
মোট ৬৩,৯২,৬৯,৫৮৩ টাকা
## দৈনিক যুগান্তরের সৌজন্যে,
Discussion about this post