দুঃস্বপ্নের ভারত সফর শেষে এখন পরিবারের সঙ্গেই পুরোটা সময় কাটছে তার। বাবা-মা আর বোন, এই নিয়ে সময় কেটে যাচ্ছে তাসকিন আহমেদের। আইসিসির বিতর্কিত বোলিংয়ে নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে দ্রুত ফেরার লড়াই শুরু করতে চান এই পেসার। তেমন সংকল্পের কথা শুনালেন ভারতের একটি পত্রিকাকে।
ক্রিকবিডির পাঠকদের জন্য সেই লেখাটি তুলে ধরা হল এখানে-
স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে পুরো বাংলাদেশ সেজে উঠেছিল বাহারি আলোর সাজে।
এখানে কনসার্ট, ওখানে আবৃত্তি, আবার কোথাও নাটক-থিয়েটার। সরকারি ভবনগুলোতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে আলোকসজ্জা করা হয়েছিল। ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবনগুলোতেও আলোর ছড়াছড়ি। এই এতোশত আলোর মধ্যে রাজধানীর জাকির হোসেন রোডে ঢুকেই মনে হলো, এই রাস্তাটা একটু ম্লান হয়ে আছে।
সিটি কর্পোরেশনের খোড়াখুড়ি চলছে বলে লোকজন, যানবাহন চলাচল নেই। যে দু-চার জন লোক এখানে ওখানে বসে আছেন, তারাও মুখ কালো করে আস্তে আস্তে কথা বলছেন।
গভীর রাতে এ রকম মনমরা একটা আড্ডার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তাজিমের বাড়িটা কোথায়?”
একজন আঙুল দিয়ে বাড়িটা দেখালেন। তারপর নিজের কথায় মন দেওয়ার আগে বললেন, “আর বাড়ি খোঁজ করে কী হবে? ছেলেটারে তো শেষ করে দিছে।”
হ্যাঁ, তাসকিন আহমেদ তাজিম। সম্প্রতি বোলিং অ্যাকশন অবৈধ বলে আইসিসি রায় দেওয়ায় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ না শেষ করে ফিরে আসতে হওয়া বাংলাদেশি ফাস্ট বোলার তাসকিন।
তাসকিন মোটেও শেষ হয়ে যাননি। চারদিক থেকে বিশ্লেষকরা বলছেন, তার বাসার লোকজন বলছেন, স্বয়ং তাসকিনও বললেন, “এটা চলার পথে একটা ধাক্কা মাত্র। হয়তো আমি এখান থেকে আরও শক্ত হয়ে ফিরতে পারব। আল্লাহ যা করেন ভালো কিছুর জন্যই করেন।”
অল্প বয়স, খুব জোরে বল করেন, কিন্তু ভেতরের মনটা খুব নরম। তাই আশেপাশের সবাই ভয় পাচ্ছেন, তাসকিন এই ধাক্কায় না ভেঙে পড়েন। তাসকিনের বাবা আবদুর রশিদ, মা সাবিনা ইয়াসমিন সেই ভয়টার কথা বলছিলেন তাসকিন এসে পৌঁছনোর আগে।
তাসকিনের বাবা ম্লান হেসে বলছিলেন, “ছোট মানুষ তো, একটু ভয় লাগে, ভেঙে না পড়ে। আর একটা ব্যাপার দেখুন, ইন্ডিয়াতে গেলেই ওর একটা কিছু বিপদ হয়। প্রথম দু’বার ইনজুরি নিয়ে দলের আগে ফিরে এল। এবার তো এই নিষেধাজ্ঞা। একটু ভয় তো করেই।”
তাসকিন একটা হাসি দিয়ে ভয় উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। কয়েক দিন পরই ২১ বছরে পা দিতে যাওয়া তাসকিন দারুণ পরিণত ভঙ্গিতে বললেন, “দাদা, সব কিছুকে পার্ট অব গেম হিসেবে দেখি। আগে হলে হয়তো অনেক কষ্ট পেতাম। এখন বুঝি, এসব নিয়েই এগোতে হবে। আর আমার কষ্ট অনেক কমে গিয়েছে মানুষের রিঅ্যাকশন দেখে। এতো মানুষ, এতো সাপোর্ট করেছেন! বিশ্বাস করুন, আমি কল্পনাও করতে পারিনি, মানুষ আমাকে এতো ভালবাসে।”
এমনিতে একটু মুখচোরা ধরনের ছেলে। কিন্তু কথা বলতে শুরু করলে অনেক গল্প আছে তার কাছে বলার জন্য। মানুষের সমর্থনের কথা বলতে গিয়ে চলে এল কোচ হাতুরুসিংহে, অধিনায়ক মাশরাফি এবং সর্বোপরি বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের কথা। কোচ ও সভাপতির সমর্থনটা তাসকিনকে বিস্মিত করেছে। আর মাশরাফির এই আবেগটা যেন ছোট ভাইয়ের পাওনাই ছিল। ‘ভাই (মাশরাফি) তো সবাইকে আপন ভাইয়ের মতো দেখে। আর আমি তো আজকাল ট্যুরে ভাইয়ের রুমে থাকি। উনি যে কষ্ট পাবে, এমন করবে, এটা আমি বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু কোচ আর বোর্ড প্রেসিডেন্ট এমন করে বলবেন, আমি কল্পনা করিনি।”
অবশ্য এই বিষয়ে কথা বেশি আর এগোতে চাইছিলেন না। বারবার মনটা খারাপ হয়ে যায় বোলিং অ্যাকশন কাণ্ডের এসব কথাবার্তা তুললে।
এর মধ্যে এক ঝলক বাতাসের মতো বড় বোনের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে ফিরে আসে ছোট্ট বোনটা। জান্নাতুল আলম রোজা এসে পৌঁছতেই পরিবেশ অনেক হালকা হয়ে যায়। বাবা-মায়ের মুখেও হাসি। তাসকিনকে নিয়ে কিছু মজা, কিছু আজগুবি পরিকল্পনা, ছোটবেলার গল্প, খুনসুঁটি এবং ক্রিকেটের আলাপ।
ক্রিকেটের আলাপ উঠতেই তাসকিনের মুখটা আরেক বার কালো হয়ে গেল, “খুব কষ্ট পেয়েছি।”
কষ্ট তো অনেকগুলো পেয়েছেন। সুপার টেনে ওঠার পার সবগুলো ম্যাচ হেরেছে বাংলাদেশ। শেষ ম্যাচে নিজেদের টি-টোয়েন্টি ইতিহাসের সবচেয়ে কম, ৭০ রানে অলআউট হয়েছে দল। তবে এ সব কষ্ট ছাপিয়ে তাসকিনের কাছে প্রধান কষ্ট ভারতের বিপক্ষে এক রানের ওই হার।
সেই হারটা হোটেলে একা একা বসে দেখেছিলেন। বলতে বলতে ঘেমে উঠছিলেন। বললেন “আমি ভাবছিলাম, প্রথম ইনিংসটা দেখে একটু বেরোব হোটেল থেকে। একা একা খেলা দেখতে ভাল লাগে না। কিন্তু এতো সুন্দর বল করল সবাই টিভির সামনে থেকে উঠতে পারলাম না। শেষ ওভারে এসে আমার হাত-পা অবশ হয়ে যাচ্ছিল। মাঠে থেকে কোনওদিন এত নার্ভাস লাগেনি। মুশফিক ভাই দুটো চার মারল, আমি চিৎকার শুরু করে দিয়েছিলাম। কিন্তু শেষ তিনটে বলে কী যে হল! এই আফসোস জীবনেও যাবে না।’
তাসকিন ফেসবুকের বেশ ভালো অনুসরণকারী। তাই জানেন, ওই তিনটে বল তার সিনিয়র দুই সতীর্থকে কেমন ‘ভিলেন’ বানিয়ে ফেলেছে। এটা নিয়ে খুব আফসোস বাংলাদেশি এই ফাস্ট বোলারের। মাথাটা নেড়ে বললেন, “দেখুন রিয়াদ ভাই আর মুশফিক ভাই আমাদের কত ম্যাচ জিতিয়েছে। ওরাই সেদিন এই জেতার মতো জায়গায় এনেছে। ওই সময়ে কী করতে হয়, তা আমাদের চেয়ে ওরা ভালো বোঝেন। কিন্তু হয়নি। জীবনে সব তো চাওয়ার মতো হয় না। ওরা চেষ্টা করেছেন, পারেননি। ওদের দোষ দেবেন না।’
জীবন নিয়ে এই বোধটা তাসকিনকে শক্ত করছে। নিজেই বলছেন, গত কয়েক মাসে তার সঙ্গে যা হচ্ছে, তিনি মানুষ হিসেবে আরও পরিণত হয়ে উঠছেন। হয়তো এই দুঃসময়ের এটাই প্রাপ্তি, “দেখুন গত বছর খানেকে বারবার ইনজুরিতে পড়ল, ফর্ম ফিরে পেলেই একটা না একটা ঝামেলা। এতে আর কিছু না হোক, আমি বুঝতে পারছি, জীবন সহজ না। আমি এখন অনেক কিছুর জন্য প্রস্তুত থাকতে পারি। আমি নিশ্চিত এই ধাক্কা কাটিয়ে আবার যখন ফিরব, আগের চেয়ে শক্ত তাসকিন হয়ে ফিরব।”
Discussion about this post