ঘটনাটা যেদিন টেস্ট সিরিজের দল ঘোষণা করা হয় সেদিনেরই। দলে নতুন কেউ এলে স্বভাবতই তাকে নিয়ে সবার একটু বাড়তি কৌতুহল থাকে। সেই কৌতুহলের দায় মেটাতেই ফোন করেছিলাম আল আমিন হোসেনকে। তাকে আগে থেকে চিনতাম না। গত কয়েক বছর তার যেমন পারফরম্যান্স, তাতে নিজে যেচে পরিচিত হওয়ার তেমন কোনো কারণ ও ছিল না। তার সঙ্গে টেলিফোন কথোপকথন স্বাভাবিক কারণেই তাই পেশাদারিত্বের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকার কথা ছিল। সেটা ছিলও। কিন্তু শেষ প্রশ্নে আল আমিন সাহেব একটু গড়বড় করে ফেললেন। জানতে চেয়েছিলাম আপনারা কয় ভাই-বোন। জবাব এলো- ‘আমরা তিন ভাই বোন, বাকি দুজনের বিয়ে হয়ে গেছে, এবার আমার পালা।’
শুনে আমার তো আক্কেল গুড়ুম। আল আমিনের বিয়ের খবর জানার আমার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তবু তিনি বললেন, প্রথমবার দলে সুযোগ পেয়েছেন। আবেগের উচ্ছ্বাসে হয়তো মাত্রা জ্ঞান একটু লোপ পেয়েছিল। তাই আর বিষয়টি ধর্তব্যে আনিনি। আল আমিন সেসময় আবাহনীর একটি ম্যাচ খেলে ফতুল্লা থেকে ঢাকায় ফিরছিলেন । বাসে তার অন্য সতীর্থরাও ছিল। জবাব শুনে তারা ও একটু হাসলো। টেলিফোনের অন্য প্রান্তে সেটা টের পেলেও আমার আর কিইবা বলার ছিল।
আসলে আল আমিনদের এখন আর কারোই কিছু বলার নেই । এরা এমন এক প্রজন্মের প্রতিনিধি যারা ব্যাটে বলে যেমন, মুখেও সমান দক্ষ। কারও কারও তো খেলাটাই চলে এসেছে মুখে। পৃথিবীর সবকিছুকে তুচ্ছ জ্ঞান করা এখন ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। অন্যকে খাটো করতে গিয়ে কেউ কেউ আবার নিজের অর্জনকেও খাটো করে ফেলেছেন। সংবাদ সম্মেলনে এসে অবাস্তব প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন । ম্যাচের গতি বিধি সম্পর্কে এমন সব উদ্ভট কথা বলছেন তাতে যে কারওই হাসি আসবে। ভাবখানা এমন, টেস্ট ক্রিকেট এমন আর কি। কাল সকালে মাঠে নামলেই তো আমরা জিতে যাবো। নিজের অর্জনকে খাটো করার কথা বলছিলাম। এই সিরিজে এর বড় প্রমাণ সোহাগ গাজী। চট্টগামে ইতিহাস গড়ে আসার পরে সংবাদ সম্মেলনে ও তিনি ‘চতুর আবদুল্লাহ’ হয়ে গেলেন। কোনো উচ্ছ্বাস নেই, উল্লাস নেই। শেষে এমন ও বললেন যে এই ম্যাচটাকে তিনি নাকি মনেই রাখবেন না। সোবার্স যা পারেননি, ইমরান যা পারেননি, টেস্ট ক্রিকেটে ১৩৬ বছরে কেউ যা পারেনি সেটা সোহাগ পেরেছে। অথচ সংবাদ সম্মেলনে সোহাগী সব প্রশ্নে সেই সোহাগই কিনা জল ঢেলে দিলেন।
সোহাগ হয়তো সচেতনভাবে এসব করেননি। কিন্তু সাকিব আল হাসান? তাকে কী বলবেন। বাংলাদেশের সবচাইতে বড় ক্রিকেটার তিনি। ভারতে যেমন শচীন, আমাদের কাছে সাকিব তার চাইতে কম কিছু নয়। কিন্তু কিছু বিষয়ে সাকিব শচীনের একদম উল্টো মেরুতে। মানতে দ্বিধা নেই, আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের বাইরে ইদানিং সাকিবের সান্নিধ্য পাওয়া দুরূহ। সাকিবকে দেখেছি এই সংবাদ সম্মেলনগুলোতে ইদানিং মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে কথা বলেন। তিনি ম্যাচে অনেক দিন পর ভালো বোলিং করেছেন । একজন জানতে চাইলেন, নিশ্চয় আপনি এখন রিলিভড। সাকিব এক শব্দে জবাব দিলেন তিনি রিলিভড না। তাতে সমস্যা ছিলনা । সমস্যা হচ্ছে তিনি এখন প্রায় সব প্রশ্নের জবাবই দেন এরকম এক দুই শব্দে। এটি যে সাংবদিকদের প্রতি স্বভাবজাত অবজ্ঞা তা বুঝতে কারও অসুবিধা হয়না। ইদানিং সাকিব আবার দেশের কিছু নিয়ম কানুনকেও অবজ্ঞা করা শুরু করে দিয়েছেন। সাংবাদিকরা না হয় সাকিবদের কথা বেচে নিজেদের পেট চালান। তাই অনেক তুচ্ছ তাচ্ছিল্য তারা মেনে নেন। কিন্তু অন্যরা সেটি মানবে কেন? এক সহকর্মীর কাছে শুনেছি এবারের ঈদে মাগুরাতেই এজন্য তাকে অপদস্ত হতে হয়েছে। সেখানে মশলার একটি গবেষণা কেন্দ্র আছে। তাতে ছুটির দিনে স্ত্রীকে নিয়ে ঢুকতে চেয়েছিলেন সাকিব। কিন্তু ছুটিতে অতিথি সমাদরের নিয়ম নেই বলে দারোয়ান তার আবদার রাখেননি। ঢাকায় ফিরে অনধিকার চর্চা করতে গিয়ে আবার তিনি বিমানবন্দরে অপমাণিত হলেন। স্ত্রীকে বিদায় দিতে গিয়ে তিনি বিমানবন্দরের প্যাসেঞ্জারদের জন্য সংরক্ষিত জায়গায় চলে গিয়েছিলেন। কর্তব্যরত নিরাপত্তা কর্মকর্তা তাকে চ্যালেঞ্জ জানালেন। নিজেকে জাহির করতে গিয়ে একটু চোটপাটও করলেন। আমি বলছিনা ভদ্রমহিলা (তিনি একজন মহিলা ছিলেন) ঠিক কাজ করেছেন। কিন্তু আবেগকে দূরে রেখে আমরা একটু ভেবে দেখি না সাকিবই বা কতটুকু ঠিক করেছেন। তিনি দেশের একজন আইকন। জাতিসংঘের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের শুভেচ্ছা দূত। সেই সাকিবই যদি নিয়মকানুনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হন তবে কে হবে। শচীনের সঙ্গে তার একটা তুলনা টেনেছিলাম। শচীন ভারতে এরকম কোনো অনধিকার চর্চা করেছেন কিনা শুনিনি।
সাকিবের তুলনায় নাসির হয়তো বিতর্কিত তেমন কিছু করেননি, বলেনও নি। কিন্তু ঢাকা টেস্টেও তৃতীয় দিনে নাসির যেভাবে সংবাদ সম্মেলনে কথা বললেন তাতে তাকে নিয়ে ও কিছু শংকা জাগছে। নাসিরকে বলা হচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের পরবর্তী মহাতারকা। আচার আচরণেও তিনি বরাবর বিনয়ী । কিন্তু সেদিন কেন যেন বিনয় নামের জড় পদার্থটিকে তিনি ড্রেসিং রুমে রেখে এলেন। সাংবাদিকদের প্রশ্ন শুনে হাসি তামাশা করলেন, কিন্তু প্রশ্নের জবাবই দিলেন না। ম্যাচের সম্ভাব্য ফল নিয়ে উদ্ভট কথা বলে নিজেও একবার হাসির খোরাক হলেন।
নাসিরদের পাশে সংবাদ সম্মেলনে প্রায় প্রতিদিনই দলের মিডিয়া ম্যানেজার থাকেন। তিনি তাদের ব্রিফ করেন কিনা জানা নেই। করলেও তারা কতটা তাকে কতোটা গুরুত্ব দেন সেটা নিয়ে ও যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। কিছু দিন আগ পর্যন্তু এই ক্রিকেটাররা তো দলের ম্যানেজারকেই গুরত্ব দিতে চাইতেন না। সংবাদ সম্মেলনে কে আসবে সেই প্রশ্নে তানজীব আহসান সাদকে বহুদিন বোবা হয়ে যেতে দেখেছি। সাকিব, তামিম, মুশফিকদের আদেশ করার মতো ব্যাক্তিত্বই তার ছিল না। কিংবা হয়তো ছিল। কিন্তু খেলোয়াড়দের অতি বড় ব্যক্তিত্বের কাছে তিনি ছিলেন ম্লান। সবাই আশায় আছেন এখন হাওয়া বদলাবে। কারণ, দলের ম্যানেজার হিসেবে এমন একজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, ব্যক্তিত্বে তিনি অন্তত পিছিয়ে নেই । আশার পিঠে আশঙ্কা একটাই। মিডিয়ার সঙ্গে খেলোয়াড়দের রূঢ় ব্যবহারের যে সংস্কৃতি তিনি নিজেই তার পথিকৃত। ব্যক্তিত্বে নতুন ম্যানেজার তাই যতই মহীয়ান হোন, দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি কতটুকু পরিবর্তন আনতে পারবেন সেটা নিয়ে তাই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে!
আজাদ মজুমদার: ক্রীড়া সম্পাদক, নিউএইজ এবং ক্রিকেট বিশ্লেষক।
Discussion about this post