মামলাটা বড় অদ্ভুত। মিরপুর মডেল থানায় সেটি করেছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা মেজর (অব.) হোসেন ইমাম। মামলার আসামি লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান, ম্যানেজার তরিকুল ইসলাম ও সমন্বয়কারী সাব্বির আহম্মেদ। দ্রুত বিচার আইনে দায়ের করা মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, অভিযুক্তদের প্ররোচনা ও নির্দেশে ৪০-৫০ জন সন্ত্রাসী ৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৭টার দিকে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ঢোকার চেষ্টা করেছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) প্রধান নির্বাহী নিজাম উদ্দিন চৌধুরী, বিসিবির দুই পরিচালক ইসমাইল হায়দার মল্লিক ও খালেদ মাহমুদ এবং সাবেক ক্রিকেটার মো. আলীসহ বিসিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হত্যা করা। এজাহারে আরও বলা হয়, নিরাপত্তাকর্মী ও আনসার সদস্যদের বাধার মুখে ব্যাপক ভাঙচুর চালিয়ে সন্ত্রাসীরা এলাকায় ত্রাস ও ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
মজাটা হচ্ছে, ভাঙচুরের চিহ্নমাত্র নেই শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের কোথাও! আরও বিস্ময়কর, স্টেডিয়ামের সীমানার মধ্যে যে এত বড় ‘লঙ্কাকাণ্ড’ ঘটে গেল, সেটা গত পাঁচ দিনেও শোনেননি বিসিবির অনেক পরিচালক! যাঁদের ‘হত্যা’ করার উদ্দেশ্যে সন্ত্রাসীরা শেরেবাংলায় ঢুকতে চেয়েছিল, তাঁদের একজন ইসমাইল হায়দার মল্লিক কোনো মন্তব্যই করতে রাজি নন। ভাঙচুরের কথা কি কিছু শুনেছেন—প্রশ্নে বললেন, ‘শুনেছি কি শুনিনি এটিও বলতে রাজি নই।’ মামলার বাদী হোসেন ইমামের মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
পুলিশের মিরপুর বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. জসিম উদ্দিন গতকাল ফোনে মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সালাহউদ্দিন খান জানিয়েছেন, তাঁরা ইতিমধ্যেই লুৎফর রহমানসহ অন্য অভিযুক্তদের খোঁজে তাঁদের বাড়িতে অভিযান চালিয়েছেন। কিন্তু অভিযুক্ত কাউকে পাওয়া যায়নি। একটি সূত্র অবশ্য জানিয়েছে, লুৎফর রহমান বর্তমানে ব্যবসায়িক কাজে নেপালে আছেন।
এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল, অথচ কাল বিসিবির বেশ কয়েকজন পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ঘটনার তিন দিন পরও তাঁরা কিছুই জানেন না! বিসিবির মিডিয়া কমিটির প্রধান জালাল ইউনুস মুঠোফোনে বলেছেন, ‘ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছে শুনেছি। ভাঙচুরের কথা তো শুনিনি।’ বিষয়টা অজানা কালই থাইল্যান্ড থেকে ফেরা পরিচালক নাঈমুর রহমানেরও, ‘আমি গত সোমবার দেশের বাইরে গিয়ে গতকাল (পরশু) ফিরেছি। কিন্তু যাওয়ার আগের দিনও এ রকম কোনো ঘটনা তো শুনিনি।’ মুঠোফোনে চেষ্টা করা হয়েছিল বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসানের সঙ্গে কথা বলারও। কিন্তু বেশ কয়েকবার ফোন করা সত্ত্বেও ফোন ধরেননি তিনি। বিসিবির আঙিনায় ও রকম কোনো মিছিল বা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটলে সেটা বিসিবির মূল ভবনের গায়ে লাগানো সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়ার কথা। বিসিবির কাছে সে রকম কোনো ফুটেজ আছে কি না, এ ব্যাপারেও কারও কাছ থেকে কিছু জানা যায়নি। বিসিবির প্রধান নির্বাহী নিজাম উদ্দিন চৌধুরী মামলা প্রসঙ্গে কোনো কথা বলতেই রাজি হননি।
সন্দেহ নেই, লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান এবং তাঁর সঙ্গীদের বিরুদ্ধে বিসিবির এই মামলা কয়েক দিন ধরে চলে আসা ঘটনাপ্রবাহেরই জের। প্রথমে লুৎফর রহমান আপত্তিকর ভাষায় বিসিবির কয়েকজন কর্মকর্তার সমালোচনা করেন। সেটার প্রতিবাদে শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে অশালীন স্লোগান দিয়ে মিছিল করে বহিরাগতরা। অমার্জিত ভাষায় সংবাদ সম্মেলন করে খেলোয়াড় কল্যাণ সমিতি, ক্লাব অ্যাসোসিয়েশন এবং স্কোরার ও আম্পায়ারদের সংগঠন। এরপর নিজের বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দেন লুৎফর রহমান। বিসিবির শৃঙ্খলা কমিটি তার পরও বিসিবির সব ধরনের ক্রিকেট থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে তাঁকে। এ ছাড়া তারিকুলকে পাঁচ বছরের জন্য এবং সাব্বিরকে তিন বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়।
কোনো শুনানি না করে, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়াটাই ক্রিকেট মহলে বিস্ময় জাগিয়েছিল। কাল মামলার খবর জানাজানি হওয়ার পর সেটি আরও বেড়েছে। অনুমিত কারণেই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ক্লাব কর্মকর্তা বললেন, ‘ঢাকার ক্লাবে ক্লাবে রেষারেষি আগে আরও বেশি ছিল। কিন্তু এখন যা হচ্ছে, এটা কখনো কল্পনাও করা যায়নি।’
#লেখাটি দৈনিক প্রথম আলো’তে ১২ ডিসেম্বর ১২ ছাপা হয়েছিল।
Discussion about this post