উৎপল শুভ্র
বিশ্বকাপের মাস দুয়েক বাকি থাকতে বাংলাদেশের ক্রিকেট অঙ্গনে কোন নামগুলো সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হওয়া উচিত বলে মনে করেন? উচিত-অনুচিত বাদ দিন, স্বাভাবিক কী, সেটিই নাহয় বলুন। মাশরাফি-সাকিব-মুশফিক-তামিম…এই নামগুলোই তো! বিশ্বকাপের প্রাথমিক দল ঘোষণা করা হয়ে গেছে। ১৫ জনের চূড়ান্ত দলে কারা থাকবেন না-থাকবেন, এ নিয়ে চা বা কফির পেয়ালায় এখন ঝড় ওঠার কথা।
ঝড় ঠিকই উঠেছে। তবে সেটি বিশ্বকাপের মতো ‘তুচ্ছ’ ব্যাপার নিয়ে নয়। নামও অনেক শোনা যাচ্ছে। তবে মাশরাফি-সাকিবদের নয়, ‘পাপন’-‘মল্লিক’-‘বাদল’-‘সুজন’…। নামগুলো এখানে অবজ্ঞাসূচক নয়। বাংলাদেশের সামাজিক রীতিতে ডাকনামের খুব প্রতাপ। মুখে মুখে তাই এগুলোই ফিরছে। কারও বুঝতেও অসুবিধা হচ্ছে না যে, এখানে বিসিবির সভাপতি ও দুই পরিচালক এবং প্রিমিয়ার লিগের দল লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের কর্ণধারের কথা হচ্ছে।
গত কয়েক দিন বাংলাদেশের ক্রিকেটে যা হচ্ছে, সেটিকে ‘অবিশ্বাস্য’, ‘অভাবনীয়’ নানা বিশেষণে অভিহিত করতে পারেন। তবে শেষ পর্যন্ত বোধ হয় ‘লজ্জাজনক’ শব্দটিতে এসে স্থির হতে হবে। একটি টেস্ট খেলুড়ে দেশের ক্রিকেট বোর্ড যেভাবে ক্লাব রাজনীতির মৃগয়াক্ষেত্র হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছে, তাতে ক্ষোভ-দুঃখ সব অনুভূতি পার হয়ে শেষ পর্যন্ত তো লজ্জাতেই বিমূঢ় হয়ে যেতে হয়।
তবে এসবের মধ্যেও একটা ‘ইতিবাচক’ দিক আপনার চোখ এড়ায়নি বলেই আশা করি। পরশু রাতে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) যে ‘অহেতুক’ একটা দুর্নাম থেকে মুক্তি পেল। কে বলে, বিসিবিতে সিদ্ধান্ত ঝুলে থাকে! এক রাতেই সিসিডিএমের সভায় নেওয়া সিদ্ধান্ত বিসিবির ডিসিপ্লিনারি কমিটিতে অনুমোদিত হয়ে যাওয়া…বিসিবির এমন করিতকর্মা রূপ এর আগে কখনো দেখা গেছে কি না সন্দেহ। সেটিও মামুলি কোনো সিদ্ধান্ত নয়। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে গত তিন-চার বছরে চ্যাম্পিয়ন দল গড়া সংগঠককে আজীবন দেশের ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে দেওয়া হলো। এমনই বিদ্যুৎগতিতে সিদ্ধান্তটা হলো, যেন এর ওপরই বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে!
লুৎফর গত বৃহস্পতিবার বিকেএসপিতে যে ভাষায় বিসিবি সভাপতি এবং আরও দুজন পরিচালককে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন, সন্দেহাতীতভাবে তা শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। চাকরিজীবী মানেই চাকর এবং চাকরবাকর দিয়ে ক্রিকেট হয় না—এই বৈপ্লবিক তত্ত্বের জনক হিসেবেও আবির্ভূত হয়েছেন তিনি। কিন্তু বিসিবির ছায়াতলে থেকে যেভাবে এর পাল্টা জবাব দেওয়া হলো, সেটি তো আরও আপত্তিকর। লুৎফর রহমান শুধুই একজন ব্যক্তি। নিজের কোনো আপত্তিকর কাজের দায়ও শুধুই তাঁর। বিসিবি তো তা নয়। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গৌরব ক্রিকেটের পতাকা তুলে ধরার দায়িত্বে থাকা একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান।
তুচ্ছ একটা ঘটনা কেন এমন ‘বিসিবি বনাম ব্যক্তি’-এর রূপ নেবে? নিয়েছে, কারণ বিসিবির প্রভাবশালী বেশ কয়েকজন পরিচালকের সঙ্গে লুৎফরের বিরোধটা অনেক পুরোনো। সেটির মূলেও ক্লাব রাজনীতিই। আর এটা নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয় যে, টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার ১৪ বছর পরও বাংলাদেশের ক্রিকেটে সেই ক্লাব-রাজই চলছে। মোহামেডানের সঙ্গে ঝামেলা হওয়ায় বেরিয়ে এসে ভিক্টোরিয়া ক্লাবে যোগ দিয়েছিলেন লুৎফর। দেদার টাকা খরচ করে ভালো দল গড়ার সঙ্গে ‘চ্যাম্পিয়নস লাক’ মিলিয়ে ভিক্টোরিয়া পর পর দুবার চ্যাম্পিয়ন। চ্যাম্পিয়ন ভিক্টোরিয়া ছেড়ে গাজী ট্যাংক ক্রিকেটার্সের স্বত্ব কিনে নিয়েও। একদা বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে রিয়াল-বার্সার মতো চিরবৈরী আবাহনী-মোহামেডান তাই ‘বাদলকে ঠেকাও’ মিশনে এককাট্টা হয়ে গেছে বেশ আগেই। বছর আড়াই আগে পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ ইউসুফের ছাড়পত্র-বিতর্কের সময়ই যা দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। যেটি আরও নগ্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে গত প্রিমিয়ার লিগে। লুৎফরের গুছিয়ে ফেলা দল এলোমেলো করে দিতেই আবিষ্কার করা হয়েছে ‘প্লেয়ারস বাই চয়েস’ নামে অদ্ভুত এক পদ্ধতির। ক্রিকেটাররা প্রতিবাদ করায় জানানো হয়েছে, এটি শুধুই এই বছরের জন্য। আগামীবার থেকে আবার আগের নিয়ম। বছরটি কী কারণে ‘হ্যালির ধূমকেতু’ দেখতে পাওয়ার মতো এমন ব্যতিক্রমী, এই প্রশ্নের জবাব এত হাস্যকর ছিল যে, তা আর লিখতে ইচ্ছা করছে না।
লুৎফরকে চরমতম শাস্তি দেওয়ায় বিসিবির সব পক্ষেরই এমন প্রবল উৎসাহ ছিল যে, নিজের বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেও রেহাই মেলেনি। লুৎফরের আপত্তিকর ভাষাটাই শুধু ধর্তব্যে নেওয়া হয়েছে, বক্তব্য একদমই নয়। যদি প্রশ্ন হয়, তাঁর অভিযোগগুলো কি খতিয়ে দেখা হয়েছে? ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে গড়াপেটা আর আম্পায়ারদের প্রভাবিত করা নিয়ে অনেক কথাই তো বাতাসে ভেসে বেড়ায়! ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক ও ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান কোনো ক্লাবের কোচের পদে থাকলে সত্যিই কি স্বার্থের সংঘাত হওয়ার কথা নয়? বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান কি কাউকে ‘কারণ দর্শাও’ নোটিশ দিয়ে জানতে চেয়েছেন, গত সোমবার মিরপুরে ‘হোম অব ক্রিকেট’ কীভাবে শয়ে শয়ে বহিরাগতের চারণভূমিতে পরিণত হলো? মিছিল-টিছিল শেষে তাঁরা বিসিবিতে আপ্যায়িত হলো কীভাবে? বিসিবির মতো একটা জাতীয় প্রতিষ্ঠানের বহির্দেয়াল কীভাবে একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ ব্যানারে ছেয়ে গেল? এই প্রশ্নগুলো বিসিবি সভাপতিকে বিব্রত (ক্ষুব্ধও কি নয়!) করে না থাকলে তো বুঝতে হয়, উত্তরগুলো তাঁর জানা।
ক্রিকেট সব সময়ই অন্য খেলার চেয়ে বেশি কৌলীন্য দাবি করে এসেছে। সমাজের অন্য কোনো ক্ষেত্রে অনৈতিক কিছু দেখলেও তাই বলা হয়, ‘ইটস্ নট ক্রিকেট!’
হায়, বাংলাদেশে তো ক্রিকেটেই ‘ক্রিকেট’ হচ্ছে না!
# লেখাটি ১১ ডিসেম্বর দৈনিক প্রথম আলো’তে ছাপা হয়েছে।
আপডেট: ১০:০৩, ডিসেম্বর ১১, ২০১৪ |
Discussion about this post