শুরুটা ২০১১ সালে। প্রায় দেড় কোটি টাকায় ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব ওল্ড ডিওএইচএস কিনে নেয় প্রাইম ব্যাংক ফাউন্ডেশন। পরের বছর এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) তত্কালীন সভাপতি আ হ ম মুস্তফা কামাল এর নাম ঘোষণা করেন প্রাইম ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাব। আর ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক করা হয় ব্যাংকটির নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান তানজিল চৌধুরীকে। এর পর ফাউন্ডেশনের অর্থে বিভিন্ন ঘরোয়া লিগে অংশ নিতে থাকে ক্লাবটি। বিভিন্ন টুর্নামেন্টেও নিয়মিত অর্থায়ন করতে থাকে ফাউন্ডেশন।
প্রাইম ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাবকে সিঁড়ি করে ২০১৩ সালে বিসিবির পরিচালকও নির্বাচিত হন তানজিল চৌধুরী। হয়ে ওঠেন দেশের ক্রিকেট হর্তাকর্তা। তানজিল চৌধুরীর এ ক্রিকেট বিলাসিতার পুরোটাই হয়েছে প্রাইম ব্যাংকের সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির (সিএসআর) অর্থে।
ইস্ট কোস্ট গ্রুপেরও ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানজিল চৌধুরী। কিন্তু ক্রিকেট ক্লাব চালাতে ইস্ট কোস্টের কোনো অর্থ ব্যয় করেননি তিনি। পুরো অর্থ গেছে প্রাইম ব্যাংক ও প্রাইম ব্যাংক ফাউন্ডেশন থেকে। অথচ ব্যাংকটির মালিকানার ৩৮ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীর। এ নিয়ে শেয়ারহোল্ডাররা যেমন ক্ষুব্ধ, একইভাবে ক্ষুব্ধ ব্যাংকের কয়েকজন পরিচালকও।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র দেশের বাইরে থাকায় এ বিষয়ে মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বিসিবির পরিচালক হতে প্রাইম ব্যাংকের সিএসআরের অর্থ ব্যয়ের বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। কিন্তু নীতিমালা না থাকায় এখনই ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। শিগগিরই নীতিমালা হবে। তখন ব্যবস্থা নেয়া হবে এবং এসব বন্ধও হয়ে যাবে।’
জানতে চাইলে প্রাইম ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. নাদের খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সুদূরপ্রসারী চিন্তা থেকেই আমরা ব্যাংকের অর্থে ক্রিকেট ক্লাব কিনেছি। এর পর প্রতিনিয়ত ক্লাবের পেছনে অর্থ ব্যয় করছি। কারণ এ ক্লাবের মাধ্যমে আমাদের যে ব্র্যান্ডিং, অন্য কিছু দিয়ে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তানজিল চৌধুরীকে ক্লাবের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে পর্ষদ থেকেই। ভবিষ্যতে অন্যান্য ব্যাংকও একই পথ অনুসরণ করবে বলে আমরা মনে করি। কারণ সারা বিশ্বেই এটা হয়ে থাকে।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রাইম ব্যাংক ওল্ড ডিওএইচএস ক্লাব কেনে ২০১১ সালে প্রায় ১ কোটি ৩৬ লাখ টাকায়। ক্লাব ক্রিকেটের পরবর্তী তিন আসরে (২০১১, ২০১২ ও ২০১৩) দল গঠন ও আনুষঙ্গিক কাজে ব্যয় হয় প্রায় ১৫ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) টাইটেল স্পন্সর কিনতে ৬ কোটি টাকার চুক্তি করে প্রাইম ব্যাংক। এর পর বিসিবির আয়োজনে প্রথমবারের মতো আয়োজিত ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক ক্রিকেট লিগ বিসিএলে ৬০ লাখ টাকায় সাউথ জোন কিনে নেয় প্রাইম ব্যাংক। পরে দুই আসরে এর পেছনে ব্যয় হয় প্রায় ৩ কোটি টাকা। আম্বর বিজয় দিবস টি২০ টুর্নামেন্টেও অর্থ ব্যয় করে ব্যাংকটি। পাশাপাশি প্রাইম ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাবের কোচ হিসেবে খালেদ মাহমুদ সুজন ও ওল্ড ডিওএইচএসের ক্রিকেট কমিটির সাবেক ম্যানেজার ও বর্তমানে প্রাইম ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাবের সহকারী ম্যানেজার সাইফুল ইসলামও প্রতি মাসে পারিশ্রমিক নিচ্ছেন ব্যাংক থেকে। এভাবে গত তিন বছরে প্রায় ৩০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে ব্যাংকটি, যা যাচ্ছে সিএসআরের অর্থে পরিচালিত প্রাইম ব্যাংক ফাউন্ডেশন থেকে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ব্যাংকটির এক পরিচালক বলেন, ক্রিকেটের পেছনে অর্থ ব্যয় করতে পর্ষদকে এক রকম বাধ্য করা হয়েছে। আধিপত্য থাকায় সহজেই তারা এসব করতে পারছেন। নিজের প্রতিষ্ঠান থাকলেও ক্রিকেটের পেছনে অর্থ ব্যয় করছেন ব্যাংক থেকে। সিএসআরের অর্থে আগে সাধারণ মানুষ যেভাবে উপকৃত হতো, এখন তা প্রায় বন্ধ হতে চলেছে।
জানা গেছে, প্রাইম ব্যাংক তাদের মুনাফার একটি অংশ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সিএসআর খাতে ব্যয় করে। কিছুদিন আগেও শিক্ষা, চিকিত্সাসহ বিভিন্ন সামাজিক খাতে সিএসআরের অর্থ ব্যবহার করত ব্যাংকটি। এতে উপকৃত হতো হাজারো শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ। তবে ২০১১ সালের শেষ দিক থেকে ফাউন্ডেশনের অর্থ ব্যবহার শুরু হয় ক্রিকেটের পেছনে। এর একমাত্র সুবিধাভোগী হয়েছেন ব্যাংকটির নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান তানজিল চৌধুরী। একে কাজে লাগিয়ে বিসিবির পরিচালকও হয়েছেন তিনি। দায়িত্ব পেয়েছেন বিসিবির ফ্যাসিলিটিজ কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে।
ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান পরিচালক সিরাজুল ইসলাম মোল্লা বলেন, ‘আমরা মূলত ব্যাংকটির ভাবমূর্তি বাড়ানোর জন্যই ক্রিকেটের পেছনে অর্থ ব্যয় করছি। তবে এর মাধ্যমে একজন উপকৃত হয়েছেন, এটা সত্য। বর্তমান মেয়াদে তিনি ক্লাবের দায়িত্বে আছেন। তবে পর্ষদ চাইলে পরবর্তী সময়ে সে পদে পরিবর্তনও আসতে পারে।’
এ প্রসঙ্গে কথা বলতে তানজিল চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রাইম ব্যাংক ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ড. ইকবাল আনোয়ারের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। ড. ইকবাল আনোয়ার এ বিষয়ে বলেন, ‘সিএসআরের একটি অংশ ক্রিকেটের পেছনে ব্যয় করা হয়। কারণ দেশের অনেক শিশু এর মাধ্যমে উঠে আসতে পারে। পাশাপাশি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে আমাদের কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। ক্রিকেটে অর্থায়নে তানজিল চৌধুরী একমাত্র সুবিধাভোগী, এটা ঠিক নয়। অর্থ প্রদানে ফাউন্ডেশনকে কোনো ধরনের চাপও দেননি তিনি। সিএসআরের অর্থে ফাউন্ডেশন নিয়মের মধ্যেই পরিচালিত হচ্ছে।’
#দৈনিক বণিক বার্তার সৌজন্যে (২২ মে, বৃহস্পতিবার)।
প্রতিবেদনটি তৈরি করছেন- সাকিব তনু ও মেরাজ মেভিজ।
Discussion about this post