দৃশ্য ১: মুশফিকুর রহিমের এলবিডব্লুর আবেদনে আম্পায়ার সাড়া না দেওয়ায় ক্ষুব্ধ সাকিব আল হাসান লাথি মেরে স্টাম্প ভেঙে দিচ্ছেন।
দৃশ্য ২: আম্পায়ার গ্রাউন্ডসম্যানদের পিচকাভার আনতে বললে রাগে ফুঁসে উঠলেন সাকিব। এবার হাত দিয়ে স্টাম্প তুলে ছুড়ে ফেললেন মাঠে।
দৃশ্য ৩: সাকিব মাঠ ছেড়ে ড্রেসিংরুমের দিকে যাচ্ছেন। আবাহনীর দর্শকেরা তাঁকে দুয়ো দিচ্ছে। সাকিবও তাদের পাল্টা কিছু বলছেন। হাত দিয়ে একটা অশোভন ভঙ্গিও করলেন বোধ হয়।
কাল মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে আবাহনীর বিপক্ষে প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচে মোহামেডান অধিনায়ক সাকিবের এই তিন কাণ্ডের সব কটিই ক্রিকেটীয় পরিভাষায় ‘অসদাচরণ’। শাস্তিযোগ্য শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধ।
প্রথমটিতে আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অশোভন প্রতিবাদ জানিয়ে নিয়ম ভেঙেছেন সাকিব। পরের দুটিতে তো আঘাত করেছেন ক্রিকেটীয় চেতনায়ও। এ ধরনের অপরাধে যেকোনো ক্রিকেটারেরই শাস্তি হওয়ার কথা। সাকিবও ব্যতিক্রম নন। ক্রিকেটের ধারা-উপধারা বিবেচনা করে ম্যাচ রেফারি নিশ্চয়ই তাঁকে প্রাপ্য শাস্তি দেবেন। সে সিদ্ধান্ত হয়ে যাওয়ার কথা আজই।
কিন্তু এই যে ক্রিকেটীয় চেতনা, সেটি আসলে কী? অল্প কথায় তা বোঝানো কঠিন। তারপরও চেষ্টা করা যাক। ধরুন, বোলার বল ছাড়ার আগেই ক্রিজ থেকে বেরিয়ে যাওয়া নন–স্ট্রাইকিং প্রান্তের ব্যাটসম্যানকে ‘মানকাডিং’ আউট করাটা যেমন এই খেলার চেতনার সঙ্গে যায় না, তেমনি মাঠে যেকোনো ধরনের অসদাচরণ, আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত ভুল হলেও তার প্রতিবাদ করা—সবই ক্রিকেটের চেতনাবিরোধী।
মোটকথা, ক্রিকেট খেলার সৌন্দর্যহানি ঘটায়, এমন যেকোনো কিছুই ক্রিকেটীয় চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
কিন্তু বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের যে বাস্তবতা, সেখানে ক্রিকেটীয় চেতনার কবর আরও অনেক আগেই রচিত হয়ে গেছে। নিচের দিকের লিগে এমনও দেখেছি, পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে খেলোয়াড় আম্পায়ারকে মুখের ওপর ‘চোর’ বলছেন। আম্পায়ার সেটি অম্লানবদনে মেনে নিচ্ছেন। ওই ক্রিকেটারের বিরুদ্ধে আম্পায়ার পরেও কোনো রিপোর্ট করেননি। ক্রিকেটারের শাস্তিও হয়নি। কারণ, আম্পায়ার জানতেন, তিনি আসলেই কোনো বিশেষ ক্লাবকে সুবিধা দিতে গিয়ে ‘চুরি’ করেছেন।
বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে এ রকম আরও অনেক ঘটনাই আছে, ক্রিকেট–উন্নত বিশ্বের দেশগুলো যেসব দেখলে বা জানলে ক্রিকেটের চেতনা সম্পর্কে তাদের ধারণায়ও প্রকাণ্ড ধাক্কা লাগবে।
ভুল আউটের প্রতিবাদ জানিয়ে ব্যাটসম্যান উইকেটের ওপর বসে আছেন। খেলা বন্ধ।আম্পায়ার খেলোয়াড়কে অনুনয় করে বলছেন, ‘আমার কিছু করার নেই। আজ তোমাদের হারাতেই হবে। নইলে আমি আর ম্যাচ পাব না।’ বছর দুয়েক আগে ফতুল্লা স্টেডিয়ামে এমন দৃশ্যেরও অবতারণা হয়েছে।
অসহায় ম্যাচ রেফারি সাংবাদিকের হাত ধরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছেন, ‘এই কাজ ছাড়া আর কোনো রোজগার নেই। ওদের পক্ষে সিদ্ধান্ত না দিলে ম্যাচ পাব না। খাব কী? প্লিজ আপনি কিছু লেইখেন না।’
মাঠে যাঁরা ক্রিকেটের আইন ফলাবেন, ক্রিকেটের চেতনা যাঁদের ছায়ায় টিকে থাকবে, তাঁরা আম্পায়ার–ম্যাচ রেফারি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, মাঠে ক্ষমতাসীন ক্লাবগুলোর নগ্ন প্রতিনিধিত্ব করে বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের আম্পায়ার, ম্যাচ রেফারিরা অনেক আগেই সেই মর্যাদার আসন হারিয়েছেন। খেলোয়াড়দের আড্ডায় এসব ম্যাচ কর্মকর্তাকে এমন এমন মুখরোচক নামে ডাকা হয়, যেগুলো শুনলে লজ্জায় তাঁরা আর মাঠমুখী হতেন কি না সন্দেহ।
আবার উল্টোটাও হতে পারে। তাঁরা হয়তো ঠিকই জানেন, খেলোয়াড়েরা তাঁদের কোন চোখে দেখেন। কিন্তু পক্ষপাতিত্বে প্রাপ্তিযোগ যেহেতু ভালো, চক্ষুলজ্জা ভুলে যত পারা যায় মাঠে গিয়ে আম্পায়ারিং করার নীতিতেই তারা বিশ্বাসী। সাকিবের ঘটনার পর কাল বিসিবির এক ম্যাচ রেফারি দুঃখ করে বলছিলেন, ‘আমরা তো ভাই চোখে পর্দা লাগিয়ে ফেলেছি।’
একের পর এক বাজে আম্পায়ারিংয়ের ঘটনা এবং ভুক্তভোগী ক্লাবগুলোর লিখিত অভিযোগের পরও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) আজ পর্যন্ত কোনো আম্পায়ারের বিরুদ্ধে তদন্ত করেছে বা কাউকে শাস্তি দিয়েছে বলে শোনা যায়নি। বাজে আম্পায়ারিং নিয়ে কখনো খুব শোরগোল পড়ে গেলে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান আশ্বাস দেন সব ঠিক হয়ে যাওয়ার। কিন্তু ঠিক আর হয় না।
বরং মাঠে বিশেষ বিশেষ ক্লাবকে অন্যায় সুবিধা দিয়ে সেই আম্পায়ার-ম্যাচ রেফারিরা সময়ের সঙ্গে আরো বেশি সুবিধাভোগীই হয়েছেন। আর তাঁদের পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্তে অন্যায়ভাবে ম্যাচ জিতে প্রভাবশালী ক্লাবগুলো পয়েন্ট তালিকায় থাকছে ওপরের দিকে। নিশ্চিত করছে বিসিবির নির্বাচনে নিজেদের শক্ত অবস্থান।
কাল যে স্টাম্পের ওপর সাকিবের পা উঠল, সেটি তাই এক দিনে হয়নি। এটা ঠিক, একটা অন্যায়ের প্রতিবাদ কখনো আরেকটা অন্যায় দিয়ে হয় না। স্টাম্পে লাথি মেরে, স্টাম্প উপড়ে ফেলে সাকিব বড় ভুলই করেছেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটে চরম বাজে এক উদাহরণ হয়ে থাকবে এই ঘটনা।
এবার যখন সাকিব মোহামেডানের সঙ্গে চুক্তি সই করেন, তখন নাকি মোহামেডান কর্মকর্তাদের কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, তিনি যে দলে থাকবেন, সেই দলের সঙ্গে আম্পায়াররা অন্যায় করার সাহস পাবেন না। হতে পারে সাকিব কথাটা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর অবস্থান চিন্তা করেই বলেছিলেন।
কিন্তু কাল মুশফিকুর রহিমের বিরুদ্ধে করা এলবিডব্লুর আবেদন আম্পায়ারের কানে প্রতিহত হয়ে আসার পর ওয়ানডের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারও নিশ্চিত বুঝে গেছেন বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের বাস্তবতা। আম্পায়ার স্বেচ্ছাবধির হলে এখানে সাকিব আল হাসানের আপিল আর কলাগাছের আপিল আসলে একই।
স্টাম্পে লাথি মেরে সাকিব কি সেই বাস্তবতার দেয়ালেই আঘাত করতে চাইলেন? সেটি হলে একটা ভয়ও আছে। সাকিবের লাথিটা ফুটবলের ‘কিকঅফে’র মতো না হয়ে যায়!
বিশেষ কিছু ক্লাবকে অন্যায় সুবিধা দিতে গিয়ে কিছু আম্পায়ার যেভাবে ম্যাচের পর ম্যাচ অন্য ক্লাবের খেলোয়াড়দের সাফল্যবঞ্চিত করে চলেছেন, বিশ্ব তারকা সাকিবকে দেখে এবার সেই খেলোয়াড়েরাও যদি তাঁর মতো প্রতিবাদী হতে শুরু করেন! মাঠের আইন তুলে নিতে থাকেন নিজেদের হাতে, পায়ে কিংবা অন্য কোনোভাবে!
সাকিবের লাথি বড় এক অশনিসংকেতেরই বোধ হয় ডাক দিল বাংলাদেশের ক্রিকেটে। তবে সাকিব অন্যায় করেছেন, এটা যেমন ঠিক, তাঁর শাস্তি পাওয়াটা যেমন উচিত; একইভাবে এ কথাও বলতে দ্বিধা নেই—নোংরা ক্লাবরাজনীতিতে কলুষিত বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের জন্য এ রকম একটা লাথি বড় দরকার ছিল।
# (লেখাটি দেশের শীর্ষ দৈনিক প্রথম আলো থেকে নেওয়া)
Discussion about this post