গামিনি ডি সিলভা পরম সৌভাগ্যবান! ভিনদেশি হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে কেন্দ্র করেই একজন দেশি ক্রিকেটারকে যে শুনানির মুখোমুখি হতে হচ্ছে! নিশ্চিত করে বলা যায়, দুই শরও বেশি বছরের ক্রিকেট ইতিহাসে এই প্রথম উইকেটের সমালোচনা করে ডিসিপ্লিনারি কমিটির মুখোমুখি হচ্ছেন কোনো ক্রিকেটার, তামিম ইকবাল খান। আর এমন ‘ঐতিহাসিক’ মুহূর্তের সন্ধিক্ষণে অগণিত ‘পাগলে’র আমদানি বিসিবির একজন পরিচালকের বরাতে।
মিরপুরের উইকেট নিয়ে জাতীয় দলের দুই সিনিয়র ক্রিকেটারের সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একজন সাংবাদিকের প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে তরুণ বোর্ড পরিচালক খেই হারিয়েই প্রশ্নকর্তাকে ‘পাগল’ বানিয়ে দিয়েছেন! সেই মানদণ্ডে পাগলের সংখ্যা অনেক। মিরপুরের উইকেট যে বিপিএলের জন্য আদর্শ নয়, সেটি তো অগুনতি সাংবাদিকের বাইরে অযুত ক্রিকেট অনুসারীও মনে করেন! তাতে ক্রিকেটের এই ‘পাগলা’ সমাজে ধরে নেওয়া যায় আপাত সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষটি হলেন ডা. ইসমাইল হায়দার মল্লিক। মিরপুরের উইকেটের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা যে পাগলামি—সেই ধারণার প্রবক্তা যে তিনিই।
যাই হোক, চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়াশোনা করেও এখন ভিন্ন পেশায় ইসমাইল হায়দার মল্লিক। আর ক্রিকেটে তাঁর ভূমিকা অত্যন্ত ক্ষমতাধর বোর্ড পরিচালক হিসেবে। বিপিএল সদস্যসচিব হিসেবে কার্যত এই আসরের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাও তিনি। অতি অল্প বয়সে প্রচণ্ড ক্ষমতার ভারে মল্লিকের হোঁচট খাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। শুনেছি, ‘পাগল’ শব্দটি উচ্চারণের জন্য পরে জিভও কেটেছেন তিনি। আর শুধু তো সাংবাদিকই নয়, বোর্ডের অনেক ‘এক্সেল সাইজে’র কর্তাকেও সময়ে সময়ে ঠাট্টাচ্ছলেই নাকি অপমানসূচক মন্তব্য করেন এই তুর্কি তরুণ।
সর্বোপরি, তীব্র ক্ষমতার আঁচে আশপাশের কিছু মানুষের গায়ে ফোস্কা পড়া বিশ্বের এই প্রান্তে নতুন কিছু নয়ও!
তাই বলে তামিম কিংবা নিজ দেশের কোনো এক ক্রিকেটারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ভিনদেশি এক মাঠকর্মীকে কোলে বসিয়ে গুণগান করবে বিসিবি—এ কেমন কথা? মাঠ-উইকেট সংক্রান্ত সমালোচনার দায় গামিনি ডি সিলভার কাঁধেই বর্তায়। নাম উচ্চারণ না করলেও একটি প্রশ্নের উত্তরে বিসিবির হেড কিউরেটরকে ইঙ্গিতও করেছিলেন তামিম রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে ৯৮ রানের লক্ষ্য হামাগুড়ি দিয়ে পূরণ করে আসার পরে। তাতেই চিঠির মাধ্যমে শুনানিতে হাজির হতে বলা হয়েছে তামিমকে। আপাতত ২১ ডিসেম্বর থেকে শুনানির তারিখ এগিয়ে ১৪ ডিসেম্বর করা হয়েছে। তবে ওই সময় তামিমের টি-১০ খেলতে দেশের বাইরে থাকার কথা। তার মানে আরেকটি পরিবর্তন অনিবার্য।
সেদিন কী হবে? মিরপুরের উইকেট ‘জঘন্য’ বলার দায়ে আর্থিক দণ্ড দেওয়া হবে তামিমকে? যত দিন ধরে খেলছেন তাতে সেই ‘মূল্য’ চুকানোর জন্য পর্যাপ্ত অর্থ-সম্পদ বাঁহাতি ওপেনারের অ্যাকাউন্টে থাকার কথা। নাকি সাসপেন্ড করা হবে এক-দুই ম্যাচ কিংবা আজীবনের জন্য? তাতেও এ দেশের ক্রিকেটে তামিমের চিহ্ন থেকে যাবে। ১০ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ১০ হাজার রান তাঁকে স্মরণের পক্ষে একেবারে কম নয়। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস অধিনায়কের মনে সম্ভাব্য শাস্তিকে ঘিরে মনে কী ঘুরপাক খাচ্ছে জানি না, তবে অভিব্যক্তিতে অপমানের ক্লেদ স্পষ্ট। উইকেটের সমালোচনা তো হরদম করে থাকেন ক্রিকেটাররা। একই ম্যাচের পর রংপুর রাইডার্স অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজাও উইকেট যে টি-টোয়েন্টিসুলভ নয়, বলেছিলেন। তাঁকে কিন্তু শুনানিতে ডাকা হয়নি।
বোর্ডের এই সিদ্ধান্তটিই সঠিক। উইকেটের আচরণ সবচেয়ে ভালো বুঝবেন অভিজ্ঞ ক্রিকেটাররাই। মাশরাফির মতো তামিমও সেটিই করেছেন। এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, শ্রীলঙ্কান বলেই গামিনির ‘পিছু’ নিয়েছেন তাঁরা, এই পদে তাঁদের কোনো ক্যান্ডিডেট আছে বলেও জানা নেই। স্রেফ ‘মেরিট’ বিচার করেই উইকেট নিয়ে অভিযোগ তুলেছিলেন মাশরাফি-তামিম। অবশ্য ক্ষণে ক্ষণে বলের গড়িয়ে যাওয়া আবার মাহমুদ উল্লাহর অফস্পিনও ব্যাটসম্যান এবং উইকেটরক্ষকের মাথা উঁচিয়ে বাউন্ডারিতে চলে যাওয়া দেখে ‘আন্ডার প্রিপেয়ার্ড’ উইকেট কোনটিকে বলে সেটি জানা হয়ে গেছে বিপিএল দর্শকদেরও!
হ্যাঁ, এই উইকেটেই ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াকে টেস্ট ম্যাচে হারিয়েছে বাংলাদেশ। এর কোনোটিরই ম্যাচসেরা হননি তামিম ইকবাল। তবে দুটি জয়েরই পথ তৈরি হয়েছিল তাঁর ব্যাটে, মাইনফিল্ডে রূপ নেওয়া এই উইকেটে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১০৪ ও ৪০ এবং অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মহামূল্য ৭১ ও ৭৮ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। ঘরের মাঠের সুবিধা সবাই নেয়, বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু বিপিএল তো কোনো দ্বিপক্ষীয় সিরিজ নয়। আর টেস্ট ম্যাচে অফুরান সময়, তাই রানের তাড়া নেই। কিন্তু টি-টোয়েন্টি তো পুরো উল্টো, তাহলে এমনতর উইকেট কেন?
তামিম ইকবালেল শুনানি বাদ দিয়ে একবার গামিনিকে ডেকে এই প্রশ্নটিই করুক না কেন বিসিবি? এই পারিষদে তিনজন সাবেক অধিনায়ক আছেন। অন্তত এই উদ্যোগটি নিন তাঁরা!
#লেখাটি দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত
Discussion about this post