বাংলাদেশের ক্রিকেটার, সংগঠক ও ফ্র্যাঞ্চাইজিরাও স্পট ফিক্সিংয়ের অন্ধকার জগতের বাইরে নেই-তা আগেই জানা। বিপিএলে ম্যাচ গড়াপেটা হয়েছে এটাও ওপেন সিক্রেট। দেশের অন্যতম শীর্ষ ক্রিকেটার মোহাম্মদ আশরাফুল অকপটে ম্যাচ পাতানোর কথা স্বীকার করে জানিয়ে দিয়েছেন ক্রিকেট জুয়ার কালো থাবা পড়েছে বাংলাদেশেও। আশরাফুলের ওই স্বীকারোক্তির পর থেকে সবার একটাই জিজ্ঞাসা-ওই কালো জগতে আসলে কাদের বিচরণ? বিপিএলে স্পট ও ম্যাচ ফিক্সিংয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের কারা জড়িত? আশরাফুল একা নাকি আরও কেউ-তা জানতে গত কয়েক মাস ধরেই উদগ্রীব গোটা বাংলাদেশ। আজই হয়তো সে অপেক্ষার অবসান ঘটতে যাচ্ছে।
ধারণা করা হচ্ছে, বিপিএলের ম্যাচ ও স্পট ফিক্সিংয়ের দীর্ঘ তদন্ত শেষে মঙ্গলবার নিজেদের অনুভব ও সুপারিশ জানাবে আইসিসি দুর্নীতি দমন ইউনিট (আকসু)। আজ বিকেল সাড়ে ৩টায় হোটেল র্যাডিসনে সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে আকসু রিপোর্ট। এ প্রতিবেদন প্রকাশ করতে গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীতে এসে পৌঁছেছে আইসিসির উচ্চপর্যায়ের এক প্রতিনিধি দল। যার নেতৃত্বে আছেন আইসিসি প্রধান নির্বাহী ডেভিড রিচার্ডসন স্বয়ং। তার সঙ্গে রয়েছেন আইসিসির হেড অব লিগ্যাল ইয়ান হিগিন, আইসিসি দুর্নীতি দমন ইউনিট প্রধান যোগিন্দার সিং, আকসু তদন্ত কর্মকর্তা অ্যালেন পিকক এবং আইসিসি মিডিয়া ম্যানেজার সামিউল হাসান। আইসিসির এ উচ্চপর্যায়ের শক্তিশালী কমিটি এসেছে, তাদের গত প্রায় ছয় মাসের তদন্ত ও সাক্ষ্য-প্রমাণে পাওয়া তথ্য জানাতে।
কেউ কেউ হয়তো ভাবছেন আজই বুঝি মোহাম্মদ আশরাফুলসহ দোষীদের শাস্তি হয়ে যাবে। কিন্তু বিসিবির ঊর্ধ্বতন কর্তাদের সঙ্গে কথা বলে ঠিক তা মনে হচ্ছে না। বিসিবি ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী নিজামউদ্দিন সুজন জানিয়েছেন, ‘মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৩টায় র্যাডিসন হোটেলে এক সংবাদ সম্মেলন হবে।’ বিসিবির বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য ও মিডিয়া কমিটি প্রধান জালাল ইউনুস জানিয়েছেন, ‘গত প্রায় ছয় মাস আকসু তদন্ত করে যেসব তথ্য ও প্রমাণ পেয়েছে, আগামীকালকের (আজ মঙ্গলবার) প্রেস মিটে সে তথ্য-উপাত্ত, আকসুর প্রাপ্তি ও সুপারিশের কথাই জানানো হবে। এরপর তার পরিপ্রেক্ষিতে বিসিবি একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে চূড়ান্ত বিচার প্রক্রিয়ায় যাবে। একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারককে প্রধান করে গঠন করা হবে ওই ট্রাইব্যুনাল। যাতে একজন প্রতিষ্ঠিত সমাজসেবক ও সাবেক ক্রিকেটারকেও রাখা হবে। তারাই আইসিসি দুর্নীতি দমন ইউনিটের সুপারিশের ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।’
এদিকে আইসিসি প্রতিনিধি দলের রাজধানী সফর নিয়ে রাজ্যের সতর্কতা ও গোপনীয়তা। হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে উপস্থিত মিডিয়াকর্মীরা তাদের নাগাল পাননি। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা অপেক্ষায় থাকলেও আইসিসি প্রতিনিধি দলকে সুকৌশলে অন্য গেট দিয়ে বের করা হয়। বিসিবি ভারপ্রাপ্ত সিইও ও অন্য কর্তারা সেখান থেকে প্রতিনিধি দলকে নিয়ে বিমানবন্দর থেকে সোজা র্যাডিসন হোটেলে চলে যান।
বোর্ডের কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে না জানালেও ভেতরের খবর-কাল রাতেই আইসিসি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের। সেখানে তাকে আইসিসি প্রতিবেদনের সারাংশ মৌখিকভাবে জানানো হবে। এতটুকু শুনে মনে হতে পারে নাজমুল হাসান আইসিসি প্রতিনিধি দলের কাছে পাওয়া প্রতিবেদন নিয়ে আজকের বোর্ড সভায় আলোচনা করবেন। কিন্তু জালাল ইউনুস সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রেস মিটের আগে বোর্ডের কাছেও আকসুর অনুভব, প্রাপ্তি ও সুপারিশের কথা জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন আইসিসি প্রধান নির্বাহী ডেভিড রিচার্ডসন।
যেহেতু আশরাফুল নিজেই নিজেকে দোষী মানছেন এবং মুখ ফুটে স্বীকার করেছেন-আমি চার-পাঁচটা ম্যাচ পাতিয়েছি; তাই আকসুর অনুভব ও পাওয়া তদন্তে আশরাফুলের দোষী প্রমাণিত হওয়া শতভাগ নিশ্চিত। এখন দেখার বিষয় আকসু তাকে কী ধরনের শাস্তির সুপারিশ করে? এছাড়া আর কেউ আকসুর জালে ধরা পড়েন কি না সেটাও দেখার।
তবে যেহেতু আশরাফুল নিজেই স্বীকার করেছেন তাই সবার দৃষ্টি তার দিকেই। কী শাস্তির সুপারিশ আসতে পারে তার? এসব ক্ষেত্রে আইসিসি দুর্নীতি দমন ইউনিটের নিয়ম-নীতি কী? তারা এসব ক্ষেত্রে কোন পথে অগ্রসর হয়? শেষ পর্যন্ত কী রকম শাস্তির সুপারিশ করে?
বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ ম্যাচ রেফারি রকিবুল হাসান সকালের খবরকে একান্তে তা জানিয়েছেন। তার সোজাসাপ্টা উচ্চারণ, ‘শুধু বিপিএলে ম্যাচ ও স্পট ফিক্সিংয়ের চূড়ান্ত রায় বিসিবির হাতে। আইসিসি দুর্নীতি দমন ইউনিটের আইনেই তার পরিষ্কার উল্লেখ আছে। বিপিএল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের উদ্যোগ ও আয়োজনের আসর। এটা আইসিসি অনুমোদিত; কিন্তু আইসিসির নিজের আয়োজন ও ব্যবস্থাপনায় নয়। তাই এর পুরো মালিকানা বিসিবির। বিপিএলে ম্যাচ ও স্পট ফিক্সিং হয়েছে কি না তা খুঁটিয়ে দেখার পাশাপাশি তদন্ত করতে অর্থের বিনিময়ে আকসুকে দায়িত্ব দিয়েছে বিসিবি। আকসু দীর্ঘ তদন্তে পাওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে একটা সুপারিশ করবে বিসিবিকে। বোর্ড সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। এটাই আইসিসির আইন।’
-দোষ স্বীকার করা আশরাফুলকে কী ধরনের শাস্তির সুপারিশ করতে পারে আকসু?
রকিবুল হাসানের ধারণা, ‘খুব কঠোর শাস্তির সুপারিশ করবে না আকসু। কেন করবে না তার ব্যাখ্যাও আছে। আশরাফুল একদম শুরুতেই নিজমুখে দোষ স্বীকার করেছে। শুধু তাই নয়, আকসুর কাছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব বলেও দিয়েছে। সেই সঙ্গে আগামীতে অন্যায় পথে আর না চলারও অঙ্গীকার করেছে, তাই তার কঠোর শাস্তি বিশেষ করে আজীবন নিষেধাজ্ঞা কিংবা ১০ বছরের শাস্তির সুপারিশের সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়। আমার মনে আশরাফুলকে আকসু অনেকটা রাজসাক্ষীর মতো ভাবছে। তাই তার বড় ধরনের সাজার সুপারিশের সম্ভাবনা কম। এখন বিসিবি ওই সুপারিশের ভিত্তিতে কোন পথে এগোয়, কত কড়া সাজার ব্যবস্থা করে সেটা তাদের এখতিয়ার। তবে আমার মনে হয় না আশরাফুলের বড় ধরনের শাস্তি হবে।’
Discussion about this post