বাংলাদেশ ক্রিকেটে মোহাম্মদ সালাউদ্দিন নামটি শুধু একজন কোচের নয়, বরং এক যুগের প্রতীক। ঘরোয়া ক্রিকেটে একের পর এক সাফল্য, বিপিএলে তিনবারের শিরোপাজয়ী কোচ- জাতীয় দলের দায়িত্ব নেওয়ার সময় তাই প্রত্যাশাও ছিল আকাশছোঁয়া। কিন্তু মাত্র এক বছর পরই সেই প্রত্যাশা মিলিয়ে গেল হতাশার মেঘে। বিসিবির সঙ্গে ২০২৭ সালের বিশ্বকাপ পর্যন্ত চুক্তি থাকা সত্ত্বেও ২০২৫ সালের ৫ নভেম্বর পদত্যাগপত্র জমা দিলেন এই কোচ।
নিজের সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যায় সালাউদ্দিন বলেন, ‘কোচিং করানোটা আমার উপভোগের জায়গা। মাঠই আমার জীবন। কিন্তু যদি সেটি উপভোগ না করি, তাহলে সরে যাওয়াই শ্রেয়।’
এই সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক বছরের জটিল বাস্তবতা- ব্যাটিং ব্যর্থতা, কৌশলগত প্রশ্ন, ভেতরের অস্থিরতা এবং কোচিং কাঠামোয় পরিবর্তনের চাপ।
এক বছরের পরিসংখ্যান: সংখ্যাই বলছে বাস্তবতা
দায়িত্ব নেওয়ার পর সালাউদ্দিনের অধীনে বাংলাদেশ খেলেছে ৫০টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ, যার মধ্যে জিতেছে মাত্র ২১টি, হেরেছে ২৯টিতে।
• ওয়ানডে: ২৫ ম্যাচে জয় মাত্র ৮, জয় শতাংশ ৩২।
• টেস্ট: ৭ ম্যাচে ২ জয়, ৪ হার, ১ ড্র— সাফল্যের হার ২৮.৫ শতাংশ।
• টি-টোয়েন্টি: ১৮ ম্যাচে জয় ১১টিতে, সাফল্য ৬১ শতাংশের কাছাকাছি।
সীমিত ওভারের ক্রিকেটে কিছুটা অগ্রগতি হলেও ওয়ানডে ও টেস্টে ছিল একেবারে উল্টো চিত্র।
ব্যাটিং কোচ ডেভিড হেম্পকে সরানোর পর সালাউদ্দিনকেই এই বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রত্যাশিত পরিবর্তন আসেনি। ওয়ানডেতে নিয়মিত ২০০ রানের নিচে অলআউট, টেস্টে ইনিংস ব্যবধানে পরাজয়, এমনকি সহজ লক্ষ্য তাড়া করতে না পারা- সবই তার মেয়াদের প্রতিচ্ছবি।
এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৩৫ রান তাড়া করতে না পারা ছিল সেই ব্যর্থতার প্রতীক। সমালোচকরা বলেন, ব্যাটারদের মানসিক দৃঢ়তা তৈরি করার জায়গাতেও সালাউদ্দিন সফল হননি।
সালাউদ্দিনের মেয়াদে কিছু কৌশলগত সিদ্ধান্তও প্রশ্নের মুখে পড়ে। নাসুম আহমেদ ও শেখ মেহেদী হাসানকে টপ অর্ডারে পাঠানো, জাকের আলী অনিককে অধিনায়ক বানানো, কিংবা ফর্মহীন খেলোয়াড়দের নিয়মিত সুযোগ দেওয়ার বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা থামেনি।
বিশেষ করে এশিয়া কাপে লিটন দাস চোটে পড়ার পর জাকেরকে অধিনায়ক বানানোর সিদ্ধান্তকে অনেকেই অযৌক্তিক ও পক্ষপাতদুষ্ট বলেই আখ্যা দেন।
এর সঙ্গে যোগ হয় পুরনো বিতর্ক- বিপিএলে সালাউদ্দিনের এক মন্তব্য, যেখানে তিনি বলেছিলেন ‘জাকের কালো বলে তাকে দলে নেওয়া হয় না।’ পরে জাতীয় দলে জাকেরের বারবার সুযোগ পাওয়ায় সেই মন্তব্যের প্রতিধ্বনি আরও জোরে ফিরে আসে।
জাতীয় দলের কোচিং স্টাফে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছেন সাবেক অধিনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুল, ব্যাটিং কোচ হিসেবে। বিশ্লেষকদের মতে, এই নিয়োগ সালাউদ্দিনের অবস্থান দুর্বল করে দেয়। ব্যাটিংয়ের দায়িত্ব দুই ভাগে বিভক্ত হওয়ায় তার ভূমিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। অনেকের মতে, সেটিই ছিল শেষ প্রেরণা— সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
সালাউদ্দিনের পদত্যাগ শুধুমাত্র একজন কোচের প্রস্থান নয়, বরং দেশি কোচদের জন্য এক ধাক্কা।
ফারুক আহমেদের নেতৃত্বাধীন বোর্ড দেশি কোচদের সুযোগ দেওয়ার নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। সালাউদ্দিনের সফলতা সেই নীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারত। কিন্তু ব্যর্থতার পর এখন প্রশ্ন উঠেছে-বিসিবি কি আবারও বিদেশি কোচদের ওপর নির্ভরতায় ফিরবে?
তবুও সালাউদ্দিনের আমলে কিছু সাফল্য এসেছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ৩–০ ব্যবধানে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়, এরপর টানা চারটি সিরিজে জয়ের ধারাবাহিকতা— এগুলো তার অবদানকেই প্রমাণ করে। তবে সেসবও ব্যাটিং নয়, বরং বোলিং এবং দলীয় একতা থেকে এসেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
দেশি কোচ হিসেবে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক, মাসে প্রায় ৯ লাখ ৬১ হাজার টাকা- নিয়েও তিনি নিজের অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি। ঘরোয়া ক্রিকেটে দাপট দেখানো সালাউদ্দিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের চাপ সামলাতে পারেননি, এটা এখন প্রায় সবার অভিমত।










Discussion about this post