প্রথম দর্শনেই ছেলেটিকে তাঁর মনে হয়েছিল বিশেষ প্রতিভা। মাত্র ৯ বছর বয়স। অথচ কী দারুণ মিডিয়াম পেস বোলিং করছে! ব্যাটিংটাও মন্দ না। এই ছেলে যে একদিন বিশ্বজয় করবে, পলকে যেন মনশ্চক্ষে তা দেখে ফেললেন সুনীল ফার্নান্ডো।
ভুল করেননি কোচ। ছোট্ট ছেলেটি একদিন ঠিকই বিশ্বজয় করেছে। তবে সেটি মিডয়াম পেস বোলিং কিংবা মিডল অর্ডার ব্যাটিংয়েও না। অফ স্পিনার হিসেবে। সুনীল ফার্নান্ডোর সেই শিষ্য সর্বকালের সেরা বোলার কিনা, এ নিয়ে খানিক বিতর্ক চলতে পারে। তবে পরিসংখ্যানের পাতা সাক্ষ্য দেবে, সর্বকালের সবচেয়ে সফল বোলার তিনি। মুত্তিয়া মুরালিধরন!
কাল দুপুরে আসগিরিয়া স্টেডিয়াম সংলগ্ন ওল্ড ট্রিনিটি স্পোর্টস ক্লাবে বসে প্রিয় শিষ্যের কথা বলতে গিয়ে গর্ব ঠিকরে বেরোচ্ছিল ফার্নান্ডোর চোখ-মুখে। ঠিক যেন উপরে জ্বলতে থাকা মধ্যাহ্নের গনগণে সূর্যের মতো। মুরালির শুরুর দিনগুলো তো ধারাপাতের মতো ধারাবর্ণণা করে গেলেন এক নিঃশ্বাসে, ‘আমি ওকে দেখেছিলাম সফট বলে খেলতে। মনে হল, ছেলেটার মধ্যে যেন বিশেষ কিছু আছে। গিয়ে বললাম, তুমি প্রপার ক্রিকেট বলে এসে অনুশীলন কর না কেন! ও বলল, মাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। এর প্রায় মাস দুয়েক পর ওর মা আমার কাছে মুরালিকে নিয়ে এল। শুরু হল, ওর সঙ্গে আমার দীর্ঘ যাত্রার।’ যাত্রার শুরুর দিকে যে মুরালির সত্যিকারের প্রতিভা বুঝতে পারেননি, সেটি স্বীকারে কুণ্ঠা নেই সেন্ট অ্যান্থনিস কলেজের এই ক্রিকেট কোচের, ‘তখন আমি ওকে মিডিয়াম পেসার ও ব্যাটসম্যান হিসেবেই পরিচর্চা করছিলাম। মুরালিকে স্কুলের অনূর্ধ্ব-১১ দলে খেলিয়েছি। অনূর্ধ্ব-১৩ দলেও। অনূর্ধ্ব-১৫ দলে এসে দেখলাম, দলে ওর চেয়েও ভালো তিনজন পেসার আছে। তাই বললাম, তুমি অফ কাটারটা অনুশীলন কর।’
ব্যস! এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি মুরালিকে। স্কুলে অফ স্পিনার হিসেবে খেলে প্রথম ম্যাচেই মুরালি পেলেন পাঁচ উইকেট। ফার্নান্ডো যখন দেখলেন যে কোন উইকেটেই ইয়া বড় সব টার্ন পাচ্ছে মুরালি, শিষ্যকে আটকে দিলেন সেখানেই। স্কুলের অনূর্ধ্ব-১৭ দলে গিয়ে আবার একই অবস্থা। এবার দলে আছে দুজন ভালো অফস্পিনার। কোচ মুরালিকে বললেন, একাদশে জায়গা পেতে লেগ স্পিন করতে হবে। তথাস্তু! গুরুর আদেশ শিরোধার্য করে লেগ স্পিন ভেলকিতে মুরালির সাত উইকেট। ‘কিন্তু সাফল্য পেলেও আমাকে মুরালি জানিয়ে দিল, লেগ স্পিনের চেয়ে অফ স্পিনটাই ভালো লাগে। স্কুল দলের প্রধান অফস্পিনার রুয়ান কালপাগে যখন শ্রীলঙ্কা অনূর্ধ্ব-১৯ দলে ডাকে পেয়ে এক সফরে গেছেন, সুযোগের দরজা আবার খুলে গেল মুরালির সামনে। আবারও ও তা নিল দু’হাত ভরে। এবার দুই্ ইনিংসে আটটি করে উইকেট নেবার পর আর কখনো স্কুল দলে মুরালির জায়গা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি’Ñ স্মৃতির সরণীতে হাঁটতে হাঁটতে বলছিলেন ফার্নান্ডো।
এরপর কালক্রমে সেই মুরালিধরন শ্রীলঙ্কা জাতীয় দলে ডাক পেলেন, হলেন সর্বকালের সেরা বোলার। শিষ্যের কোন কীর্তিতে সবচেয়ে গর্বিত কোচ? ‘৫০০ উইকেট পাবার সময় এর স্বীকৃতিতে এখানকার ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন একটি স্যুভেনির দিয়েছিল মুরালিকে। আমার হাত দিয়ে এই আসগিরিয়াতে সেটি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া মুরালির ৮০০ উইকেটের সময়ও আমি মাঠে ছিলাম। এ দুটিই সবচেয়ে আনন্দের’Ñ ঝলমলে চোখে দ্যুতি ছড়িয়ে ফার্নান্ডোর ঘোষণা। আরেকজন মুরালি কখনো আসবে বলেও মনে করেন না তিনি। এটি কি শিষ্যের প্রতি ভালোবাসাপ্রসূত? ঠিক মানলেন না কাঁচাপাকা চুলের এই প্রৌঢ়, ‘তা নয়। দেখুন, মুরালির চেয়ে অনেক প্রতিভাবান ছাত্র আমি পেয়েছি। কিন্তু প্রতিভার সঙ্গে পরিশ্রম, একাগ্রতা, শতভাগ দেবার যে মানসিকতাÑ সেটি আর কারো মধ্যে দেখিনি। এখনো দেখি না। সেজন্যই আমার মনে হয় না আরেকজন মুরালিধরন কখনো ক্রিকেটে আসবে।’
এই যে মুরালি পরবর্তীতে বিশ্বজয় করেছে, তবে সুনীল ফার্নান্ডোর কাছে রয়ে গেছেন সেই ছোট্টটি হয়ে। সেটি বলতে বলতে বুকের ছাতি যেন দু’হাত ফুলে ওঠে তাঁর, ‘ওকে ৯ বছর বয়সে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম, তখন যেমন ছিল, এখনো তাই আছে। আমার কাছে ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় নানা উপদেশ চেয়েছে। গত সপ্তাহে ফোনে কথা হওয়ার সময় বলল, ২৯ তারিখ আসবে আসগিরিয়ায়। ওর ছেলে নাকি স্পিন বোলিং করছে। কিন্তু কিছু সমস্যা হচ্ছে। আমাকে সেটি নাকি শুধরে দিতে হবে!’
মুত্তিয় মুরালিধরনের গুরুর জন্য এর চেয়ে বড় গুরুদক্ষিণা আর কী হয়!
Discussion about this post