ম্যাচের ১৪ মিনিটে উরুগুয়ের ডিয়েগো ফোরলান যদি পেনাল্টি মিস না করতেন, তাহলে ম্যাচের ফল কী হতো বলা মুশকিল। তেমনি দ্বিতীয়ার্ধে খেলা শুরুর ৩ মিনিটের মধ্যে যখন ব্রাজিল রক্ষণভাগের ক্ষমার অযোগ্য ভুলে উরুগুয়ের এডিনসন কাভানি ম্যাচের ফল ১-১ করে দিলেন, তখন বেলো হোরিজোন্তের ব্রাজিল সমর্থকদের মনে ‘মারাকানা ট্র্যাজেডির’ আতঙ্ক। শেষ পর্যন্ত ফিফা কনফেডারেশন কাপের প্রথম সেমিফাইনালে ম্যাচ শেষ হওয়ার ৪ মিনিট আগে পাওলিনহোর গোলে ব্রাজিল ২-১ গোলে উরুগুয়েকে হারিয়ে প্রত্যাশিতভাবেই ফাইনালে গেছে। তবে কোপা চ্যাম্পিয়নরা রীতিমতো পরীক্ষাই নিয়েছে লুই ফেলিপ স্কলারির দলের। কিন্তু ধারের সঙ্গে ভারেও কেটে বেরিয়ে গেছে ব্রাজিল। যেমনটা ম্যাচ শেষে বলেছেন উরুগুয়ে অধিনায়ক ডিয়েগো লুগানো-‘ব্রাজিল এমন দল যারা নিজেদের অপেক্ষাকৃত বাজে দিনেও জিতে বেরিয়ে যেতে পারে। আসলে এমনটা পারে গ্রেট দলগুলোই।’ তার জবাবে স্কলারি বলেছেন-‘এমন কঠিন ম্যাচ জেতা মানেই আমরা ক্রমে পরিণত হচ্ছি ২০১৪ বিশ্বকাপের জন্য।’
কী হয়েছিল ম্যাচে তা জানতে চলুন ম্যাচের ভেতর ঢোকা যাক। নেইমার, পাওলিনহো, হাল্ক, ফ্রেড, অস্কার, জো’দের নিয়ে স্কলারি যতই দুরন্ত আক্রমণ গড়ুন না কেন, তার ডিফেন্সে বিস্তর ফাঁক রয়েই গেছে। ডানদিকে দানি আলভেস সম্ভবত তার সেরা সময়টা পেরিয়ে এসেছেন। বাঁদিকে মার্সেলোর চটকদার খেলাতে যখন-তখন বিপদের সম্ভাবনা থাকে। সেন্ট্রাল ডিফেন্সে অধিনায়ক থিয়াগো সিলভা এবং ডেভিড লুইসের মূল সমস্যা গতি মন্থরতা। তার ওপর লুইসের অযথা ফাউল করার প্রবণতাও বিপজ্জনক। এমন একটি অযথা কেলেঙ্কারিতেই দলকে ডোবাতে বসেছিলেন লুইজ। কর্নার থেকে পেনাল্টি সীমানার মধ্যে জার্সি টেনে লুগানোকে ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। পেনাল্টির বাঁশি বাজাতে দেরি করেননি রেফারি। কিন্তু ফোরলানের দুর্বল শট বাঁদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে রুখে দেন জুলিও সিজার। ভিলেন হতে গিয়ে বেঁচে যান লুইজ। আর উরুগুয়ের কোচ অস্কার তাবারেজের আক্ষেপ-‘পেনাল্টি মিসটা ম্যাচের ফলে বড় একটা প্রভাব রেখেছে।’
আগের তিন ম্যাচে নেইমার তিন গোল করেছিলেন। এদিন হয়তো গোল পাননি। কিন্তু দলের দুই গোলেই ছিল তার ভূমিকা। তবে অস্কার, পাওলিনহো এবং ফ্রেড উরুগুয়ের রক্ষণভাগ ভেদ করতে পারছিলেন না। কারণ ম্যান টু ম্যান মার্কিংয়ে নেইমারদের খেলার জন্য ফাঁকা জায়গা দিচ্ছিল না উরুগুয়ে। বিপরীতে ফোরলান, সুয়ারেজ ও কাভানিকে নিয়ে দুরন্ত আক্রমণই সাজিয়েছিলেন তাবারেজ। কিন্তু উরুগুয়েও ব্রাজিলের রক্ষণে এসে খেই হারিয়ে ফেলছিল। আসলে দু’দলই অতিরিক্ত হুশিয়ার থাকার কারণে নিখুঁত পাসিং গেম চোখে পড়েনি। খেলা আটকে ছিল মধ্যমাঠ থেকে দু’দলের হাফ সীমানা পর্যন্ত।
ব্রাজিল ম্যাচের প্রথম সুযোগটি পেয়েছিল ৩০ মিনিটের সময়। নেইমারের সঙ্গে ওয়ান টু পাসিং খেলে হাল্ক যে শট নেন তা উরুগুয়ে পোস্টের বাইরে দিয়ে চলে যায়। শেষ পর্যন্ত স্বাগতিকরা এগিয়ে যায় ম্যাচের ৪১ মিনিটের সময়। উরুগুয়ে ডি-বক্সে উঁচু বল ফেলেছিলেন পাওলিনহো। সেই বল ধরে নেইমার গতিতে এক ডিফেন্ডারকে পেরিয়ে গোলে শট নেন। সেটি উরুগুয়ে গোলকিপার ফার্নান্দো মুসলেরা কোনোমতে বাড়ানো হাতে প্রতিহত করলেও বল গিয়ে পড়ে ফ্রেডের পায়ে। ব্রাজিল স্ট্রাইকার আলতো শটে বল জালে জড়িয়ে দেন। নেইমারের মতো চার ম্যাচে তিন গোল হল ফ্রেডের। প্রথমার্ধে ব্রাজিল এগিয়েছিল ওই এক গোলেই।
কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে খেলার শুরুর তিন মিনিটেই সমতা। সেটা ব্রাজিল ডিফেন্সের অমার্জনীয় ভুলে। অধিনায়ক থিয়াগো সিলভা বল পাস করতে চেয়েছিলেন মার্সেলোকে। কাছেই যে কাভানি দাঁড়িয়ে সেটা চোখেই পড়েনি! সেই পাস মার্সেলোর কাছে যাওয়ার আগেই ধরে নেন নেপোলি স্ট্রাইকার। তারপর সহজ গোল। সারা মাঠ স্তব্ধ। ব্রাজিল সমর্থকদের মনে অশুভ ভাবনা, আবার কি ফিরে আসছে অভিশপ্ত ‘১৯৫০’। কারণ গোল করে উদ্দীপ্ত উরুগুয়ে। কিন্তু ব্রাজিলকে বাঁচিয়ে দেয় দুরন্ত আক্রমণভাগই। আর তাতে নায়ক পাওলিনহো এবং নেপথ্যে নেইমার। ৮৬ মিনিটে নেইমার যে কর্নার করেন, সেই বলে পাশে থাকা উরুগুয়ে ডিফেন্ডার কাসেরেসকে টপকে জোরালো হেডে গোল করে যান পাওলিনহো (২-১)। খেলোয়াড়দের সঙ্গে উল্লাসে ফেটে পড়ে ব্রাজিল সমর্থকরাও। তারপর ম্যাচের শেষ কয়েক মিনিট উরুগুয়েকে ঠেকিয়ে রেখে ব্রাজিল নাম লেখায় ফাইনালে। যাদের সামনে এখন হ্যাটট্রিক কনফেডারেশন কাপ শিরোপা জেতার হাতছানি।
Discussion about this post