স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন
তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই মোহাম্মদ আশরাফুল সব স্বীকার করে নিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে এখন নিশ্চিতভাবে সব দোষ আশরাফুলের ঘাড়েই চাপবে। অনেকে তাই চাপাচ্ছেনও। তবে ম্যাচ ফিক্সিং বিতর্ক নিয়ে চারধারের যে পরিস্থিতি সেটা বিশ্লেষণ করলে আমার কাছে সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে আশরাফুল এখানে বলির পাঁঠা। এ ব্যাপারটায় আশরাফুল তো কোনোমতেই একা দায়ী হতে পারে না। আর ক্রিকেটে কেউ কোনো ম্যাচ একলা পাতাতে পারে না। ফুটবলে একলা ম্যাচ পাতানো সম্ভব। গোলকিপার বল ছেড়ে দিয়ে গোল খেয়ে ফেলল! কিন্তু ক্রিকেটে কোনোদিন একলা একটা ম্যাচ পাতানো সম্ভব নয়। হার-জিত নিয়ে কোনো বাজি হলে সেটা কখনই কোনো ক্রিকেটার একাকি তৈরি করতে পারে না। হ্যাঁ, স্পট ফিক্সিং-অবশ্য একাকি করা সম্ভব। নির্দিষ্ট বলে নির্দিষ্ট রান। ইচ্ছাকৃত নো বল করা। ওভারের অত নম্বর বলটা ওয়াইড করা-এমনতর আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব স্পট ফিক্সিং হয় সেটা কোনো ক্রিকেটার একাকি করতে পারে। তবে দল হার-জিতের প্রশ্নে যে ফিক্সিং হয় তার সঙ্গে অবশ্যই চার-পাঁচজন ক্রিকেটার জড়িত থাকে। আর এই চার-পাঁচজন অথবা তিন-চারজন ক্রিকেটারকে নিয়ে এমন ফিক্সিং যখন হয় তখন সেখানে অবশ্য অবশ্যই দলের কর্তৃপক্ষ জড়িত। এটা থেকেই আমাদের বোঝা উচিত-দায়ী কে? দোষ কার?
কোনো সন্দেহ নেই আশরাফুল অন্যায় করেছে। কিন্তু সেই অন্যায় স্বীকার করার যে সত্সাহস সে দেখিয়েছে তাকে আমি স্যালুট জানাই। দীর্ঘদিন ধরে দেশের সঙ্গে যে অন্যায় করছিল আশরাফুল, সেই যন্ত্রণায় পুড়ছিল সে। সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতেই আশরাফুল নিজের দোষ স্বীকার করে জাতির সামনে সত্য কথাটা বলতে পেরেছে। আমি তো মনে করি আশরাফুলের এ স্বীকারোক্তির মধ্যেই তার আসল শাস্তি হয়ে গেছে। তাই আমি দেশবাসীকে আহ্বান জানাব-আশরাফুলকে যেন সবাই ক্ষমার চোখে দেখেন। সে যে অনেক বড় ভুল করেছে তা আমরা সবাই জানি। তবে তার এ ভুল থেকেই আমরা বাকিরা সবাই শিক্ষা নিতে পারি। দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রুথ কমিশনের সেই কথাটা এখন আমার মনে পড়ছে-‘আমরা যারা সংগঠক। আমরা যারা খেলোয়াড়। আমরা যারা অন্যায় করেছি, না বুঝে করেছি, ব্যক্তি স্বার্থে করেছি। তাদের উচিত এখন সামনে এগিয়ে আসা। এই অন্যায়গুলো থেকে, এই ভুল থেকে নিজেদের মুক্ত করা। নিজেদের ভুলগুলো জনগণকে জানানো। এ জিনিসগুলো আজ এবং এখন থেকেই শুরু করা উচিত।’
এখন প্রশ্ন হল-আমাদের ক্রিকেটে এ ম্যাচ ফিক্সিংয়ের বিষবৃক্ষ এল কীভাবে?
আমার কাছে এ প্রশ্নের উত্তরটা এমন-ধরুন, একটা ভবনে যদি হঠাত্ করে বটগাছ গজাতে শুরু করে তবে সেটা থেকে মুক্তি পাওয়ার সাধারণ উপায় দুটো। প্রথমত, কিছুদিন পরপর সেই বটগাছ ছেঁটে ফেলা। এভাবে ছাঁটলে অবশ্য কিছুদিন পর ডালপালা আবার গজাবে। আর দ্বিতীয় উপায় হল-সেই বটগাছকে শিকড় থেকে একেবারে উপড়ে ফেলা।
কে কোন পদ্ধতি নেবে-সেটা তার বুদ্ধিমত্তাই ঠিক করে দেবে।
এখন যদি বাংলাদেশ ক্রিকেট থেকে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের বিষবৃক্ষ শিকড় থেকে উপড়ে ফেলতে হলে আমাদের নজর দিতে হবে ঘরোয়া ক্রিকেট লিগগুলোর দিকে। ফিক্সিংয়ের এ বিষবৃক্ষ তো ঘরোয়া ক্রিকেট লিগগুলো থেকেই শিখছে ক্রিকেটাররা। যে পরিবারের বাবা-মা নিজেরাই সারাদিন জুয়া খেলে-ঘুষ খায়, তারা কী করে চিন্তা করতে পারে তাদের সন্তানরা বিশ্বের সেরা সন্তান হবে। সত্ সন্তান হবে। আমাদের ক্রীড়াঙ্গনও তাই। আমি জানি আমার এ লেখা পড়ে অনেক ক্রিকেট সংগঠক ক্ষেপে যেতে পারেন। কিন্তু আমি ঝুঁকি নিয়েই সত্য কথা বলছি। ম্যাচের আগে ক্রিকেট সংগঠক যদি দলের ক্রিকেটারদের বলেন-আজ তোমাকে কয়েকটা নো বল করতে হবে। আজ এই ম্যাচটা হেরে যেতে হবে। তাহলে সেই খেলোয়াড় তো তার সেই নির্দেশের বাইরে যেতে পারবে না। এখান থেকেই সেই খেলোয়াড় খেলার দুনম্বরি জেনে যাচ্ছে। পরবর্তীতে তার সামনে যখন আরও বেশি অর্থের প্রলোভন আসবে তখন তো সেই লোভের গর্তে সে পড়বেই।
ম্যাচ ফিক্সিংয়ের বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলতে হলে আমাদের মূলত ক্লাব পর্যায় থেকে এর মূল উত্পাটন করতে হবে। ক্লাব পর্যায়ের সবচেয়ে বড় দুঃখজনক অধ্যায় হল-ক্লাবের কাউন্সিলর হওয়ার জন্য ২৪ ঘণ্টা আগে এক বস্তা টাকা দিলেই হল। কাউন্সিলর হওয়ার এই যে দুনম্বরি পদ্ধতি, তারই আরও উন্নততর সংস্করণ হল ফ্র্যাঞ্চাইজি পদ্ধতি। হঠাত্ গায়েবি একটা আওয়াজ উঠল। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা গোনা শুরু হল। ক্রিকেট বোর্ড তার ভাগ পেয়ে গেল। খুশিতে ডগমগ। ক্রিকেটের ‘ক’ও না জানা লোকজন হঠাত্ করেই ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিতে ক্রিকেটের মালিকানা পেয়ে গেল। বিপিএলে হঠাত্ করে যে ফ্র্যাঞ্চাইজি সাহেবরা বস্তা বস্তা টাকা দিয়ে ক্রিকেটের মালিকানা কিনলেন-ওনারা কোথা থেকে এলেন? এত টাকা ওনারা কোথায় পেলেন? ওনারা নিয়মিত ট্যাক্স দেন কি না? ওনারা যে প্রতিশ্রুতি নিয়ে ক্রিকেটের মালিক বনে গেলেন, তার পক্ষে যথোপযুক্ত কাগজ বা দলিলপত্র আছে কি নেই? দেশের সাধারণ জনগণ সেসব কিছুই জানে না।
এখন আমি বিপিএলে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের বিচার প্রসঙ্গে বলব। শুধু এক আশরাফুলের বিচার করলে এই কেলেঙ্কারির সুরাহা হবে না। আমি মনে করি যেহেতু কেলেঙ্কারির শুরুটা হয়েছে বিপিএলে, তাই এ টুর্নামেন্ট পরিচালনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরকেও বিচারের আওতায় আনতে হবে। বিচার করতে হলে পুরোটা নিয়েই করতে হবে। আর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) লোকজনও তো এসবের সঙ্গে জড়িত। যেহেতু তারা এসব কেলেঙ্কারি ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি-তাই তারা কোনোমতেই দায় এড়াতে পারে না। ক্রিকেট বোর্ড জোর গলায় বলতে পারবে না-অমুক ক্রিকেটারকে আমরা তৈরি করেছি। আমাদের দেশে প্রায় সব ক্রিকেটার নিজেদের চেষ্টায় তৈরি হয়ে আসে। টেলিভিশনের পর্দায় আলোচনা অনুষ্ঠানের আগে মেকআপম্যান যেভাবে গালে খানিকটা পাউডারের প্রলেপ লাগিয়ে দেয়, ক্রিকেট বোর্ড ক্রিকেটারদেরও ঠিক তেমনই খানিকটা প্রলেপ দেয়। বাকি সবকিছুতেই ক্রিকেটাররা নিজেরাই তৈরি হয়ে আসে। এ ক্রিকেটারদের পরিচর্যা ও সঠিকভাবে পরিচালনা করার দায়িত্ব তো ক্রিকেট বোর্ডের। আমার প্রশ্ন হল-সেই কাজটা কি ক্রিকেট বোর্ড ঠিকমতো করতে পারছে?
লেখাটা শেষ করি আশরাফুলের সম্ভাব্য বিচার প্রসঙ্গ দিয়ে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে সম্ভবত আকসুর তদন্ত রিপোর্ট পাবে বিসিবি। তারপর তারা আশরাফুল সম্পর্কে চূড়ান্ত রায় জানাবে। আর সবার মতো আমিও আশরাফুলের অন্যায়ের বিচার দাবি করি। আশরাফুল আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। কিন্তু সেই সঙ্গে মনে রাখতে হবে-আশরাফুল আমাদের আনন্দেও ভাসিয়েছে অনেকবার। তাই আশরাফুলকে শাস্তি দেওয়ার সময় অবশ্যই দেশের প্রতি তার অবদানের কথা যেন আমরা ভুলে না যাই।
# লেখক : বিসিবির সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশের বিশিষ্ট স্থপতি
Discussion about this post