বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সফল অধিনায়ক তিনি। এখনও টেস্টে বাংলাদেশের সর্বাধিক ফিফটির মালিক হাবিবুল বাশার। দেশের প্রথম টেস্ট হাফ সেঞ্চুরিয়ান তিনি। ক্রিকেট ক্যারিয়ারের মতোই উজ্জ্বল তার সেকেন্ড ইনিংস। শুধু সার্থক প্রেমিকই নন। সফল ও গর্বিত স্বামী ও একজন বাবা।
প্রেমিক হিসেবে কেমন ছিলেন তিনি? স্ত্রী শাওনের মন পেতে খুব কষ্ট করতে হয়েছে? প্রেমিক বাশারকে খুব শক্ত বাধা পার করতে হয়েছে? জানতে ইচ্ছা করছে, তাই না।
শুনুন বাশারের প্রেম কাহিনী। সময়টা নব্বইয়ে দশকের প্রথম ভাগ। ১৯৯২-৯৩ সালের কথা। আজকের সফল তারকা তখনও তরুণ। মাত্র এইচএসসি পাস করেছেন। এমন তারকা খ্যাতিও ছিল না। জাতীয় দলে সুযোগ মেলেনি। ক্লাব ক্রিকেট খেলতেন। গোপীবাগের ব্রাদার্স ইউনিয়ন ছিল তার দল। তখন এখনকার মতো সারা বছর ক্রিকেট হতো না। ক্রিকেট ছিল শীতকালের খেলা। নভেম্বর থেকে মাস তিনেক কিংবা সর্বোচ্চ চার মাস চলত। ওই সময়টাই ঢাকায় থাকতে হতো। কখনও ক্লাব টেন্ট আবার কোনো সময় খালাত ভাইয়ের বাসায় উঠতেন। ক্লাব ক্রিকেট খেলতে আসা সময়টুকু ছাড়া থাকতেন কুষ্টিয়া শহরে পরিবারের সঙ্গে। কুষ্টিয়ায় থাকা অবস্থায় প্রেমে পড়েন সেদিনের ১৮ বছরের তরুণ বাশার। প্রেমিকা শাওনও একই শহরের মেয়ে। তখন স্কুলছাত্রী। বেশিরভাগ তরুন-যুবার যেমন হয়, বাশারের তা হয়নি। শাওন তার পাড়ার মেয়ে নন। একটু দূরে বাসা। সেখানেই প্রথম দেখা। প্রথমে ভালো লাগা। তারপর ভালোবাসা। ছোট্ট শহর। একদিন বান্ধবীদের সঙ্গে বেড়াতে এসেছিলেন শাওন। সেখানে বন্ধুদের সঙ্গে ছিলেন বাশার। হঠাত্ চোখ পড়ল এক কিশোরীর দিকে। আপনাআপনি বলে ফেললেন, বাহ, মেয়েটি তো বেশ সুন্দর। প্রথম দর্শনে প্রেম নয়, ভালো লাগা। খোঁজ নেওয়া হল কোথায় থাকে। চলল ছোট্ট অভিযান। জানা গেল বাসা খুব দূরে নয়। রিকশায় মিনিট পনেরর পথ। দেখার পথও হয়ে গেল। শাওনদের এলাকায় ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হতো নিয়মিত। তাতে অংশ নিতে যেতে হতো প্রায়ই। তখন দেখা হতো। চোখাচোখি হতো। এই দেখাদেখির পর্ব খুব বেশি দিন চলেনি। অল্প সময়ই ভালো লাগা। তারপর ভালোবাসা। কে যে প্রথম প্রেম নিবেদন করেছিলেন? বাশার ঠিক মনে করতে পারছেন না। সহধর্মিণী শাওনেরও মনে নেই। তবে একপক্ষের নয়। একজন আরেকজনকে ভালোবেসেছিলেন একসঙ্গেই।
ভালোবাসা যেখানে প্রবল, সেখানে দেখা-সাক্ষাতের আন্তরিক তাগিদ ও অনুভবও খুব বেশি। কিন্তু দেখা করা কঠিন। মফস্বল শহর। আয়তনে খুবই ছোট্ট। দেখা করতে যাওয়ায় আছে বড় ঝক্কিতে পড়ে যাওয়ার শঙ্কা। কে দেখে ফেলবে। হুম… ডুবে ডুবে জল খাওয়া হচ্ছে।
কথার বাণে পিষ্ট হতে হবে। পরিবারে ঝড় উঠবে। সব ভেবে-চিন্তে ঠিক হল, দেখাদেখি কম। অভিসারে বের হওয়ার প্রয়োজন নেই। কথা হবে টেলিফোনে। কিন্তু সেখানেও বিপত্তি। শাওনদের বাসায় ফোন থাকলেও বাশারদের বাসায় ছিল না। ১৭-১৮ বছর আগের কথা, এখনকার মতো হাতে হাতে মোবাইল ছিল না। কথা বলার একমাত্র মাধ্যম ছিল ল্যান্ডফোন। কিন্তু তাতেও বিপত্তি। বাশারের বাসায় ফোন নেই। তাহলে কি করা? বন্ধুদের সঙ্গে শলাপরামর্শের পর সমস্যা সমাধানের পথ বেড়িয়ে এল। ঠিক আছে, কথা হবে ফোনে ফোনেই। শাওন বাসায় আর বাশার টেলিফোন বুথ থেকে। সঙ্গী বন্ধুরা পাশেই থাকত। বাশার টেলিফোন বুথে গিয়ে কথা বলতেন। আলাপ চলত অনেকক্ষণ। এদিকে পাবলিক টেলিফোন বুথ। প্রয়োজনীয় আলাপ থাকে অনেকেরই। একজন অতটা সময় ধরে কথা বললে কি চলে? শুরু হল হইচই। ‘এই যে ভাই, এতক্ষণ একা কথা বললে আমরা কি করব? আমাদের তো টেলিফোনে কথা বলা প্রয়োজন।’ চিত্কার-চেঁচামেচিতে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যাওয়া। বন্ধুরাই ত্রাণকর্তার ভূমিকায়। তাদের সাহায্যে সেই বিব্রতকর অবস্থা থেকে পরিত্রাণ। একদিন নয়। কয়েকদিনই ঘটেছে অমন ঘটনা। প্রতিবারই বন্ধুরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছেন। আর বাশার-শাওন একান্তে আলাপে মগ্ন থেকেছেন।
এক সময় আরও কাছে আসার আকুতি। না দেখলে ভালো লাগত না। কিন্তু বাইরে কোথাও গিয়ে দেখা করা যাবে না। তাহলে উপায়? হ্যাঁ একটা উপায় আছে। শাওন বাসার ছাদে ওঠে। সেই ছাদের আশপাশে কোথাও গিয়ে দেখা করতে হবে। কিন্তু সুবিধাজনক জায়গা মিলল না। অবশেষে পাওয়া গেল। তবে আশপাশের কোনো বাড়ির ছাদ নয়।
এক স্বর্ণকারের কারখানায়। সেখানেই বন্ধুদের নিয়ে ছুটে যাওয়া। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেই স্বর্ণকারের কারখানায় অবস্থান। ওদিকে অ্যাসিডের ঝাঁঝে কম্ম কাবার। বন্ধুরা এখানেও অগ্রণী ভূমিকায়। এখন দেখা হলে সেই বন্ধুদের রসিকতা, মনে আছে, তোর জন্য কত কষ্টই না করেছি? সোনারুর অ্যাসিডের ঝাঁঝের মধ্যেও বসে থেকেছি।
এরপর যা হয়। একপক্ষ মানে শাওনের পরিবারের পক্ষ থেকে বাধা। শাওনের ভাই বেঁকে বসলেন। নাহ, কিছুতেই এ সম্পর্ক রাখা চলবে না।
শাওনকে শাসিয়ে দেওয়া হল, খবরদার, এ ছেলের সঙ্গে মেলামেশা করতে দেখলে আর রক্ষে নেই। বাশারকে রীতিমত হুশিয়ার করে দেওয়া হল। এ পাড়ায় দেখলে মেরে পা ভেঙে দেওয়ার হুমকিও শুনতে হল। কিন্তু প্রেম থেমে থাকেনি। বরং গতি বাড়ল। আন্তরিক টানও বাড়ল অনেক। এক সময় বাশারের মনে হল, না, ঢের হয়েছে। এখন পরিণতির দিকে ঝোঁকা উচিত। এক পর্যায়ে নিজ পরিবারকে রাজি করানো গেল। সিদ্ধান্ত হল প্রস্তাব পাঠানোর। বংশ মর্যাদা বেশ ভালো। ছেলে দেখতে সুন্দর। স্বভাব-চরিত্রও ও বেশ ভালো। না করার কিছু নেই। তারপরও বাধার দেয়াল তৈরি হল। ছেলে তো তেমন কিছু করে না। শুধু ক্রিকেট খেলে। ক্রিকেটারের কাছে মেয়ে বিয়ে দিলে অর্থনৈতিক মুক্তি ও সমৃদ্ধি আসবে কি? প্রশ্ন উঠল। এখন সাকিব, তামিম, আশরাফুল, মুশফিকুর ও মাহমুদউল্লাহরা ক্রিকেট খেলেই কোটিপতি। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি এ অবস্থা ছিল না।
কাজেই প্রশ্নটা বড় হয়েই দেখা দিল। তারপরও এক সময় কেটে গেল। এরই মধ্যে ১৯৯৫-৯৬-এ সুযোগ এল জাতীয় দলে। এটাও প্লাস পয়েন্ট হল। এক সময় কেটে গেল সব বাধা। সাব্যস্ত হল বিয়ে হবে। আগে হল বাগদান। আংটি বদল হল। কিন্তু দেখাদেখির সুযোগ মিলত খুব কম। অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে এক সময় ঠিক হল বিয়ের দিনক্ষণ। ১৯৯৭ সালের ২৫ এপ্রিল কুষ্টিয়ায় বিয়ে। বর বেশে শাওনের বাড়িতে গেলেন বাশার। মহাধুমধামে হয়ে গেল বিয়ে। চমত্কার পরিণতি পেল বাশার ও শাওনের প্রেম।
কিছুদিন কুষ্টিয়ায় বাশারদের বাড়িতে থাকা। এক বছরের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় চলে আসা। মোহাম্মদপুরে যে ভাইয়ের বাসায় থাকতেন, তার কাছেই নতুন বাসা নেওয়া হল। কিছুদিনের মধ্যে কুষ্টিয়ার মায়া কাটিয়ে চলে এলেন শাওনও। শুরু হল নতুন সংসার। যার পরতে পরতে ভালোবাসার রেণু মাখা। ভালোবাসা আরও প্রবল হল। এক সময় কোলজুড়ে এল সন্তান। ২০০২ সালের ১৬ মার্চ জন্ম হল প্রথম সন্তান তানজিম বাশারের। আনন্দের বান ডেকে গেল বাশার ও শাওনের মনে। প্রথম সন্তান হওয়ার পর ক্রিকেটার বাশার হয়ে গেলেন জাতীয় দলের অধিনায়ক। তার নেতৃত্বে জাতীয় দল পেল নজরকাড়া সাফল্য। নয় বছর পর এবার জুনে এল আরেক অতিথি ‘তাহিম বাশার’।
বেশ সুখেই দিন কাটছে তাদের।
Discussion about this post