(এইতো গত বুধবার (১৮ জুন) রায় ঘোষণা হয়েছে। আন্তর্জাতিক এবং ঘরোয়া সব ধরনের ক্রিকেটে ৮ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হলেন বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুল। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) ফিক্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকায় বুধবার বিশেষ ট্রাইবুন্যাল এই শাস্তি ঘোষণা করে। সঙ্গে জরিমানা করা হয়েছে ১০ লাখ টাকা। নায়ক থেকে খলনায়ক বনে যাওয়া আশরাফুলের ক্যারিয়ারের শুরু আর সাফল্যের গল্পটা জেনে নিন এই প্রতিবেদন থেকে)
তার শুরুর গল্পটা সত্যিকার অর্থেই একেবারেই ‘গল্পের’ মতো!
সেটা ছিল ১৯৯৩ সাল। রাজধানীর মৌচাক মোড়ের সিদ্ধেশ্বরীর বালুর মাঠে অমরজ্যোতি ক্লাবের ক্রিকেটাররা এক কোনায় নেট বেঁধে অনুশীলন করত। অমরজ্যোতির অন্যতম ‘জ্যোতি’ তখন খালেদ মাহমুদ সুজন। ঢাকার ঘরোয়া ক্রিকেটে আলো ছড়ানো অনেক তারকা ক্রিকেটার এ অমরজ্যোতি ক্লাবে এসে অনুশীলন করতেন।
সেই অনুশীলনে এই অনেকের ভিড়ে আরও একজন ছিলেন। মোহাম্মদ আশরাফুল। তবে তখন তার পরিচয় ‘তারকা’ নয়, নেহাত একজন ‘বয়বয়’। নেটে মাঝেসাজে বোলিং-টোলিং করার হালকা সুযোগ মেলে আর কি! নয় বছর বয়সী সেদিনের শুকনো আশরাফুলকে দেখে অমরজ্যোতির অধিনায়ক খালেদ মাহমুদ জানতে চান-‘তুমি কী করো, ক্রিকেটার হতে চাও?’
আশরাফুলের জবাব-‘আমি লেগ স্পিন করতে পারি, যদি সুযোগ দেন তাহলে সেটা দেখাতে পারি।’
সুজন তাকে সুযোগটা দিলেন। ব্যাট হাতে নিয়ে হেলেদুলে নেটে ব্যাটিং স্ট্যান্স নিলেন ইমরান হামিদ পার্থ। ঢাকার ঘরোয়া ক্রিকেটে পার্থ তখন মারকুটো ওপেনার হিসেবে পরিচিত। বিশেষ করে স্পিন সামনে পেলে তার ব্যাট আরও বেশি হিংস্র হয়ে ওঠে। সেই পার্থের সামনে সেদিনের ‘পিচ্চি’ আশরাফুল!
সবার আশঙ্কা আজ না বল হারিয়ে যায়!
হল উল্টো! নেটে আশরাফুলের প্রথম বলেই পার্থ পুরোপুরি পরাজিত। দারুণ টার্ন এবং বাউন্সে বোকা বনেন পার্থ। নেটের আশপাশ থেকেও বিস্ময়ধ্বনি-‘দুর্দান্ত বল!’
আশরাফুলের গল্পের সেই শুরু।
অমরজ্যোতিতে পরের মৌসুম থেকে নিয়মিত তিনি। নিজেকে পরিচয় দেন-‘আমি বোলার, যে কিছুটা ব্যাটও করতে পারে।’
শেষমেশ লেগ স্পিনার আশরাফুলের সেই পরিচয় বদলে যায়। পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যান হয়ে ওঠেন তিনি। কোচ ওয়াহিদুল গনির নিপুণ পরিচর্যায় আশরাফুল বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে ভালো পারফরম্যান্স দেখিয়ে জাতীয় দলে নাম লেখান মাত্র ১৭ বছর বয়সে। অভিষেক টেস্টেই সেঞ্চুরি পান। মুরালিধরনের স্পিন ও চামিন্দা ভাসের পেস বোলিংয়ের বিরুদ্ধে কলম্বোতে করা তার সেই সেঞ্চুরি এখনও বিশ্বরেকর্ড। টেস্টে সবচেয়ে কমবয়সে সেঞ্চুরির তার সেই রেকর্ড এখনও অক্ষুন্ন।
ভাবছেন ‘গল্প’ শেষ! নারে ভাই, আছে আরও আছে!
কলম্বোর যে মাঠে জীবনের প্রথম টেস্টে সেঞ্চুরি করে বিশ্বরেকর্ড গড়েছিলেন আশরাফুল, সেই মাঠেই ছয় বছর পর আবার খেলতে নামেন তিনি; তবে এবার তার পরিচয় ভিন্ন-এবার তিনি বাংলাদেশ জাতীয় দলের অধিনায়ক! যে মাঠে বিশ্বরেকর্ড সেই মাঠে অধিনায়কত্বের অভিষেক-নিজের ক্রিকেট জীবনের স্ক্রিপ্ট যেন নিজ হাতেই লিখেছেন আশরাফুল!
অধিনায়ক হিসেবে আশরাফুল প্রথম টস করতে নামার দিন কলম্বোর তাজ সমুদ্র হোটেলের সেই সকালে দারুণ আÍবিশ্বাসী ছিলেন। অধিনায়কত্ব দর্শন সম্পর্কে আশরাফুলের নিজস্ব সেই ব্যাখ্যা স্পষ্ট মনে আছে। আশরাফুল বলছিলেন-‘অধিনায়কত্ব আসলে শুধু মাঠে ম্যাচের দিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কোনো চাকরি নয়। মাঠের বাইরেও আছে অধিনায়কের কাজ। এক অর্থে সেটাই আসল কাজ। পুরো দলকে একটা ইউনিট হিসেবে পরিণত করা। বিপদে পড়া ক্রিকেটারের পাশে দাঁড়ানো। দলে ঐক্য ঠিক রাখা। সাম্যতা রক্ষা করা। অনেকদিন আগে থেকেই সুমন ভাই (হাবিবুল বাশার) আমাকে বলতেন তুই পারবি। তোকে সামাল দিতে হবে। আমি মানসিকভাবে তখন থেকে ভেতরে ভেতরে নিজেকে তৈরি করতে শুরু করি। জাতীয় দলের হয়ে এই প্রথম অধিনায়কত্ব করছি। কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটে তো আগেই তা করেছি। সেই অভিজ্ঞতা এবং দলের ভেতর থেকে সবার কাছ থেকে যে রকম সমর্থন ও সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছি তাতে আমি এ অ্যাসাইনমেন্টে সফল হতে আÍবিশ্বাসী।’
এক যুগ আগে সিদ্ধেশ্বরীর বালুর মাঠে লেগ স্পিন করতে আসা ছেলেটি বাংলাদেশের পঞ্চম টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে টস করতে নামলেন কলম্বোর এসএসসি গ্রাউন্ডে।
– রাজত্ব তো পেলেন, এবার?
আশরাফুল সেদিন হেসেছিলেন। শব্দহীন সেই হাসিটা বলছিলÑ‘আমি পারব। আমাকে পারতেই হবে।’
অধিনায়ক আশরাফুল পারেননি।
১৩ টেস্টে ১২টিতে হার। একটি ড্র। ৩৮ ওয়ানডের ৩০টি হার। আটটি জয়। ১১টি টি-টুয়েন্টির নয়টি হার। দুটিতে জয়। অধিনায়ক আশরাফুলের এই পারফরম্যান্সকে পাস মার্ক দেয়নি বিসিবি।
তাই আশরাফুলের অধিনায়ক জীবনের ‘গল্পের’ পুরো অংশটা বিষাদময়।
হাবিবুল বাশারকে সরিয়ে যখন মোহাম্মদ আশরাফুলকে বাংলাদেশের পঞ্চম টেস্ট অধিনায়ক করা হল তখন প্রশ্ন উঠেছিল-আশরাফুল অধিনায়ক, কেন?
উত্তর ছিল পরিষ্কার-দলের সেরা ব্যাটসম্যান আশরাফুল। তাই তিনি অধিনায়ক।
কিন্তু অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর আশরাফুল সেই মর্যাদা যে ধরে রাখতে পারলেন না। ব্যাটসম্যান হিসেবে এমনসব বাজেভাবে আউট হতে শুরু করলেন যে-অধিনায়কদের প্রায়ই যে অভিযোগ শুনতে হয়, সেটা আশরাফুলকেও শুনতে হল-‘অধিনায়কত্ব তার ব্যাটিংয়ে প্রভাব ফেলেছে।’
আশরাফুল অবশ্য কখনই এ অভিযোগ মানেননি। পরিসংখ্যান দেখিয়ে বলেছেন-‘অধিনায়ক হওয়ার পর ওয়ানডেতে আমার ব্যাটিং গড় বরং আগের চেয়ে ভালো হয়েছে।’
তা ঠিক।
-কিন্তু টেস্টে?
আশরাফুল এবার যুক্তিতে হারছেন।
অধিনায়ক হওয়ার আগে নিজের ৩৫ টেস্টে আশরাফুল তিন সেঞ্চুরি, সাতটি হাফসেঞ্চুরি পান। সে সময় টেস্টে তার রানগড় ছিল ২৪। অধিনায়কত্বের ১৩ টেস্টে আশরাফুল দুটি সেঞ্চুরি করেন। দুটিই আবার প্রিয় প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। কোনো হাফসেঞ্চুরি নেই। এ সময় তার রানগড় ছিল ২২। ক্রিকেট মোদ্দাকথায় ক্যাপ্টেন্স গেম। দল খারাপ খেললে সবার আগে অভিযোগ ওঠে অধিনায়কের দিকে। আর দলের সেই খারাপ খেলায় যদি অধিনায়কও খারাপ খেলেন তখন সঙ্গে সঙ্গেই জোরদার আন্দোলন-হটাও অধিনায়ক!
২০০৯ সালে ইংল্যান্ডে টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দল পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। এমনকি আয়ারল্যান্ডের কাছেও হারে। আর সেই টুর্নামেন্টে কুৎসিত ভঙ্গিতে আশরাফুলের আউটই তার অধিনায়কত্বের মুকুট কেড়ে নেয়।
আশরাফুল ‘গল্পের’ ফ্ল্যাশব্যাক-
১৯৯৩ সালে নেট বোলার হিসেবে শুরু।
১৯৯৭ সালে অমরজ্যোতি ক্লাবের হয়ে দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেট শুরু।
২০০১ সালে জাতীয় দলে অভিষেক। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে।
২০০১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর-কলম্বোতে টেস্ট অভিষেকেই সেঞ্চুরি। সবচেয়ে কম বয়সে সেঞ্চুরির বিশ্বরেকর্ড।
২০০৭ সালের ২ জুন-টেস্ট যুগে বাংলাদেশের পঞ্চম অধিনায়কের দায়িত্ব পান।
২০০৭ সালের ২৫ জুন-কলম্বোর এসএসসি মাঠে বাংলাদেশের অধিনায়ক হিসেবে পথচলা শুরু।
২০০৯ সালের জুন-অধিনায়ক পদ থেকে বরখাস্ত।
এরপর দল থেকে বাদ পড়া। আবার ফিরে আসা। আবার বাদ পড়া। আরেকবার ফিরে আসা। টিকে থাকার সংগ্রাম।
-কী বললেন?
আশরাফুলের এই গল্প কোথায় থামবে?
উত্তরটা লেখা আশরাফুলের ব্যাটে!
Discussion about this post